কয়েক সপ্তাহ আগেই হিংসার আগুনে জ্বলে উঠেছিল মুর্শিদাবাদ। ‘নবাবের শহর’-এর বিভিন্ন প্রান্তে দেখা গিয়েছিল বিক্ষোভের চিত্র। এবার সেই মুর্শিদাবাদের হিংসা নিয়ে কলকাতা হাইকোর্ট গঠিত কমিটির রিপোর্টে উঠে গুরুতর অভিযোগ । সেখানে স্থানীয় তৃণমূল নেতার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে যে তাঁর নেতৃত্বেই হামলার ঘটনা ঘটেছে।
মুর্শিদাবাদ হিংসা নিয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তাঁরা মুর্শিদাবাদে গিয়ে একটি রিপোর্ট প্রস্তুত করেছেন। ওই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, শুধুমাত্র বেতবোনা এলাকাতেই ১১৩টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমনটাই সূত্র মারফত জানা গিয়েছে।
সেই সঙ্গে দাবি করা হয়েছে, যে সকল আক্রান্তরা মালদহে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁদের জোর করে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিলো । এর পাশাপাশি পুলিশের (West Bengal Police) বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়েছে ওই তদন্ত কমিটির রিপোর্টে। আরও দাবি করা হয়েছে, স্থানীয় কাউন্সিলর মেহবুব আলমের নেতৃত্বে হামলা হয়েছে। সবকিছু দেখার পরেও উর্দিধারীরা একপ্রকার নিষ্ক্রিয় ছিলেন। সূত্র মারফত এমনটাই জানা গিয়েছে। যদিও সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন স্থানীয় কাউন্সিলর।
তৃণমূল কাউন্সিলর মেহবুব বলেন, ‘কেউ যদি বলে আপনি আমার বাড়ি এসে ভাঙচুর করেছেন, তা মুখে বললেই কি হয়ে যাবে? প্রমাণের প্রয়োজন নেই? অশান্তির সময় আমি প্রাণ বাঁচাতে নাদাবপাড়ায় লুকিয়ে ছিলাম। তাহলে আমি কীভাবে বেতবোনাতে গিয়ে ভাঙচুর করলাম? আমি তো একজন মানুষ। নাদাবপাড়া থেকে আমি কীভাবে সেখানে গেলাম?’
এছাড়াও জানা যাচ্ছে, হাইকোর্টের গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে সামশেরগঞ্জের বিধায়ক আমিরুল ইসলামের নাম উল্লেখ করা হয়নি। বলা হয়েছে, তিনি তদারকি করে আবার ফিরে যান। একটি স্থানে নাকি উল্লেখ করা হয়েছে, আমিরুল ইসলাম নামের একজন ব্যক্তি তাণ্ডবস্থল পরিদর্শন করেন। এই বিষয়টি নিয়েও চাপানউতোর চলছে।উল্লেখ্য, জাস্টিস সৌমেন সেন ও জাস্টিস রাজা বসু চৌধুরীর ডিভিশন বেঞ্চে এপ্রিল ২০২৫-এ মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জে হিন্দুদের ওপর হওয়া একতরফা আক্রমণের সত্যতা প্রমাণ করেছে হাইকোর্ট নিযুক্ত তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটিতে ছিলেন যোগিন্দার সিং (রেজিস্ট্রার, ল, এনএইচআরসি), সত্য অর্ণব ঘোষাল (সেক্রেটারি, লিগ্যাল সার্ভিসেস অথরিটি ), এবং সৌগত চক্রবর্তী (রেজিস্ট্রার, জুডিশিয়াল, হাইকোর্ট)।
মূল তদন্ত রিপোর্টে যা উঠে এসেছে সেগুলো হলো:
১. ওয়াকফ ইস্যুকে কেন্দ্র করে ৪-৮ এপ্রিলের মধ্যে বিক্ষোভ শুরু হয়ে হিংসাত্মক রূপ ধারণ করে।
২. পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল; একাধিকবার ফোন করা সত্ত্বেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
৩. ১১ এপ্রিল, শুক্রবার, স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর মেহবুব আলমের নেতৃত্বে মুখোশধারী দুষ্কৃতীরা হিজলতোলা, শিউলিতোলা এবং ডিগরি এলাকায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়।
৪. জলের লাইন কেটে দেওয়া হয়, যাতে আগুন নেভানো সম্ভব না হয়।
৫. চন্দন দাস ও হরগোবিন্দ দাসকে স্থানীয় মুসলিম প্রতিবেশীরা হত্যা করে।
৬. দোকানপাট লুটপাট, মন্দির ভাঙচুর, নারীদের উপর সন্ত্রাস—সবই পুলিশ স্টেশন থেকে মাত্র ৩০০ মিটার দূরে ঘটে, অথচ পুলিশ নির্বিকার থাকে।
৭. দুষ্কৃতীরা সকলেই স্থানীয়—বাবুল শেখ, আক্রম শেখ, সোহেল শেখ, মুহম্মদ শেখ প্রমুখ।
৮. শুধু ঘোষপাড়ায় লুট:২৯টি দোকান, বেতবোনায় পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ১১৩টি হিন্দু বাড়ি। ১২ই এপ্রিল কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের পরে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে বর্তমানে স্থানীয়রা স্থায়ীভাবে BSF মোতায়েনের দাবি জানাচ্ছেন, কারণ রাজ্য পুলিশের ওপর তাদের বিন্দুমাত্র আস্থা নেই।
উল্লেখযোগ্য যে, মুর্শিদাবাদ হিংসার প্রভাব বাংলার রাজনীতিতেও পড়েছে। হাইকোর্টের (Calcutta High Court) নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সরের নাম উঠে আসার পর থেকেই এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। যদিও ওই নেতা সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, প্রাণ বাঁচানোর জন্য নাদাবপাড়ায় লুকিয়ে ছিলেন। তাহলে কীভাবে বেতবোনায় ভাঙচুর করতে গেলেন বলে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।