কাল থেকে বদলে যাচ্ছে দেশের আইন ব্যবস্থা! কি কি নতুন আইন থাকছে জেনে নিন!
আগামী সোমবার থেকে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা এবং তিনটি নতুন অপরাধমূলক আইন সারা দেশে কার্যকর হতে চলেছে। বিরোধীদের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও, নরেন্দ্র মোদী সরকার এই আইনগুলি প্রয়োগ করছে। ১ জুলাই থেকে, ব্রিটিশ আমলের পুরানো নিয়মাবলী ভারতীয় আইন ব্যবস্থা থেকে পুরোপুরি বাতিল হয়ে যাবে এবং স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরের ভারতের নতুন আইনগুলি তার স্থান নেবে। কেন্দ্রের দাবি অনুযায়ী, আগে আইনে শুধু শাস্তির কথা বলা হত, কিন্তু নতুন আইনের মাধ্যমে ন্যায়ের প্রতি জোর দেওয়া হবে যাতে সাধারণ মানুষ ন্যায় পান।
মোদী সরকারের এই তিনটি আইন নিয়ে বিতর্ক অনেক হয়েছে। সংসদে বিলগুলি পেশ হওয়ার পর থেকেই বিরোধিতা শুরু হয়। বিরোধী দলগুলি লোকসভা ও রাজ্যসভায় বিল নিয়ে আলোচনায় অংশ নেয়নি। সংসদের ভিতরে এবং বাইরেও তারা সমান প্রতিবাদ জানিয়েছে। গত লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাহুল গান্ধীর বক্তৃতায় ন্যায় সংহিতা নিয়ে প্রতিবাদের বিষয়টি প্রধান ছিল। বিরোধীরা এই আইন বাতিলের দাবিতে আইনি পথেও হেঁটেছে এবং সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছে, যদিও অভিযোগ টিকেনি। তবুও সংসদের দুই কক্ষে তিনটি অপরাধমূলক আইনের বিল পাশ হয়ে গেছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু বিলে সই করেন এবং চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে কেন্দ্রীয় সরকার নতুন আইনগুলি কবে থেকে কার্যকর হবে তা জানিয়ে দেয়। ভারতীয় বিধানে ন্যায়দণ্ডের কাছে সবাইকে সমান চোখে দেখার কথা বলা হলেও, নতুন তিনটি আইন দেশে নতুন ন্যায়দণ্ড স্থাপন করেছে।
উল্লেখ্য, ১৮৬০ সালে প্রণীত ‘ইন্ডিয়ান পেনাল কোড’ (ভারতীয় দণ্ডবিধি) এর স্থলাভিষিক্ত হয়েছে ‘ভারতীয় ন্যায় সংহিতা’। একইভাবে, ১৮৯৮ সালের ‘ক্রিমিনাল প্রসিডিওর অ্যাক্ট’ (ফৌজদারি দণ্ডবিধি) পরিবর্তিত হয়ে ‘ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা’ এবং ১৮৭২ সালের ‘ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট’ (ভারতীয় সাক্ষ্য আইন) প্রতিস্থাপিত হয়েছে ‘ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম’ দ্বারা।
নতুন আইনে বিভিন্ন অপরাধ এবং তার শাস্তি সম্পর্কে অনেকেই দ্বিধায় রয়েছেন। জানা গেছে, ন্যায় সংহিতায় নতুন করে ২০টি অপরাধ সনাক্ত করা হয়েছে। ভারতীয় দণ্ডবিধিতে থাকা ১৯টি বিধান ন্যায় সংহিতা থেকে বাদ গিয়েছে। এছাড়া, ৩৩টি অপরাধের জন্য কারাদণ্ডের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে এবং ৮৩টি অপরাধের জন্য জরিমানার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আরও ২৩টি অপরাধ চিহ্নিত হয়েছে যেখানে একটি বাধ্যতামূলক সর্বনিম্ন শাস্তির প্রাবধান রয়েছে।
হত্যা, আত্মহত্যায় প্ররোচনা, আক্রমণ, গুরুতর আঘাতের মতো অপরাধগুলির জন্য ভারতীয় দণ্ডবিধিতে যে বিধানগুলি ছিল, সেগুলি নতুন আইনেও বজায় রাখা হয়েছে। এছাড়া, সংগঠিত অপরাধ, সন্ত্রাসবাদ, গণহত্যার মতো অপরাধগুলি নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে।
নতুন আইনে নারী সুরক্ষা এবং নারীদের প্রতি অপরাধের ক্ষেত্রে বিধি আরও কঠোর করা হয়েছে। নয়া আইনে ১৮ বছরের নীচে নাবালিকা ধর্ষণের জন্য মৃত্যুদণ্ড বা আজীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। গণধর্ষণের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ২০ বছর থেকে আজীবন কারাবাসের সাজা নির্ধারিত হয়েছে। যৌন হিংসার মামলায় নির্যাতিতার বয়ান তাঁর বাড়িতে নেওয়া হবে, এবং এক জন মহিলা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সেই বয়ান নথিবদ্ধ করা হবে। বিয়ে বা অন্য প্রতিশ্রুতি দিয়ে মহিলাদের সঙ্গে যৌন সম্পর্কের অপরাধে ১০ বছরের সাজার বিধান রয়েছে।
চুরি, ডাকাতি, প্রতারণা প্রভৃতি অপরাধের জন্য ভারতীয় দণ্ডবিধির যে বিধানগুলি ছিল, সেগুলি নতুন আইনেও বহাল থাকছে। এছাড়া, সাইবার অপরাধ এবং আর্থিক প্রতারণা প্রভৃতি নতুন অপরাধগুলিও এই আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতদিন গণপিটুনির জন্য কোনো পৃথক আইন ছিল না, কিন্তু এখন এমন অপরাধে মৃত্যু ঘটলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। পরিবেশ দূষণ এবং মানব পাচার প্রভৃতি অপরাধগুলিকেও ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় সাজার আওতায় আনা হয়েছে, এবং এই অপরাধগুলির জন্য পৃথক বিধান রয়েছে। মহিলাদের হার বা মোবাইল ছিনতাই প্রভৃতি ঘটনার বিচারের জন্যও পৃথক আইন রয়েছে।
দেশদ্রোহের মতো অপরাধগুলি ভারতীয় ন্যায় সংহিতা থেকে সরানো হয়েছে, তবে ভারতের সার্বভৌমত্ব, একতা এবং অখণ্ডতা বিপন্ন করা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে, এবং নতুন আইনে এই অপরাধের জন্য নির্দিষ্ট সাজা নির্ধারিত হয়েছে।
শুধু ন্যায় সংহিতা নয়, সোমবার থেকে ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতাও চালু হচ্ছে। ফৌজদারি দণ্ডবিধি থেকে নতুন আইনে কিছু পরিবর্তন এবং বাতিল করা হয়েছে। নতুন আইনে অভিযুক্তের অধিকার আরও শক্তিশালী করা হয়েছে, এবং অভিযুক্তরা নিজেদের পছন্দের আইনজীবী নির্বাচন করতে পারবেন।
যদি পুলিশ কাউকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করে, তাহলে তাকে অবশ্যই অপরাধের কারণ জানাতে হবে। সেই সাথে, ধৃত ব্যক্তির শারীরিক পরীক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকার একজন চিকিৎসক নিযুক্ত করবে। নতুন আইনে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার দক্ষতা বৃদ্ধির কথাও বলা হয়েছে।
জনস্বার্থে, পরোয়ানা ছাড়াই কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব। অপরাধ তদন্তে পুলিশের ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে, তবে তদন্ত সম্পন্ন করার জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা নতুন আইনে নির্ধারিত হয়েছে। বিচার প্রক্রিয়াকে দ্রুত করার জন্য মামলা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তির বিধান রয়েছে।
একইভাবে, নতুন ‘ভারতীয় সাক্ষ্য আইন’ অনেক নতুন নিয়ম নিয়ে কার্যকর হচ্ছে। অপরাধের প্রমাণ সংগ্রহে ভিডিও রেকর্ডিং বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, এবং সেই ভিডিও প্রমাণ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নিম্ন আদালতে জমা দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে। নতুন আইনে এটাও বলা হয়েছে যে, অনলাইনে অভিযোগ করলে, তিন দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট থানায় গিয়ে এফআইআরে সই না করলে তা গ্রাহ্য হবে না।
বিরোধীরা দেশদ্রোহিতা সংক্রান্ত বিধি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। আইপিসির ১২৪(ক) ধারায় ‘দেশদ্রোহিতা’ অপরাধটি এবারের ন্যায় সংহিতায় ১৫২ ধারায় উল্লেখিত আছে। যদিও ওই শব্দটি বাদ দিয়ে, দেশের ‘সার্বভৌমত্ব ও ঐক্য’র বিরোধিতায় কঠোর শাস্তির প্রাবধান রয়েছে। বিরোধীরা মনে করেন, নাগরিকরা এই বিষয়টি গভীরভাবে বুঝতে পারবেন না। গত দশ বছরে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে উঠে আসা অভিযোগের মতো, সমালোচনা বা বিরোধিতা করলে দমনমূলক পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে। অপরাধ ও সন্ত্রাস দমনে যুক্ত নতুন ধারাগুলিতে সরাসরি অধিকার খর্ব করার দাবি করেছেন বিরোধীরা। নতুন আইন কার্যকর হওয়ার আগে, রাজ্যসভায় তৃণমূলের দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন রবিবার বিরোধিতার কথা স্মরণ করিয়েছেন।
কংগ্রেস সহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলি বিল পাশের তাড়াহুড়োর বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু মোদী সরকারের জন্য বিল পাশ করাতে কোনো বেগ পেতে হয়নি। এখন সেই নতুন আইন দেশে বলবৎ হতে চলেছে। মমতা ব্যানার্জি আইন বলবৎ না করে পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছিলেন, এমনকি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিও লিখেছিলেন। আইনজীবীদের একাংশের মতে, এই তিন আইনে পুলিশের হাতে অতীতে না থাকা ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই তিন আইন চালু হলে দেশে আইনি জটিলতা বাড়বে। তবে সব বিতর্ক সরিয়ে রেখে, সোমবার থেকে দেশে নতুন তিন আইন কার্যকর হতে চলেছে।