
মহারাষ্ট্র ভোটে জিতবে কে? সমীক্ষায় ত্রিশঙ্কুরও ইঙ্গিত !‘বাজ়িগর’ হতে পারেন ৪ ‘ছোট’নেতা !
মহারাষ্ট্র বিধানসভার ২৮৮ আসনের জন্য ‘জাদু সংখ্যা’ হল ২৪৫। আসন্ন ২০ নভেম্বরের একদফা নির্বাচনে, বিজেপি-শিবসেনা (একনাথ শিন্ডে)-এনসিপি (অজিত) জোট ‘মহাজুটি’ এবং কংগ্রেস-শিবসেনা (ইউবিটি)-এনসিপি (শরদ) জোট ‘মহাবিকাশ আঘাড়ী’ এই সংখ্যা অর্জনের লড়াই করছে। যদি ২৩ নভেম্বরের গণনায় কোনো জোটই এই সংখ্যা অর্জন করতে না পারে (যেমনটা কিছু জনমত সমীক্ষা ইঙ্গিত করছে), তবে কী হবে?
এই প্রশ্নের মধ্যেই নতুন সমীকরণের সম্ভাবনা আলোচনায় আসছে। কিছু ভোট বিশ্লেষকের মতে, ছোট দল ও নির্দলীয় প্রার্থীরা মিলে প্রায় ২৫টি আসনে জয়লাভ করতে পারে (২০১৯ সালের নির্বাচনে তারা মোট ২৯টি আসনে জিতেছিল)। এবং এই ‘সম্ভাব্য’ পরিস্থিতিতে, চারটি ‘ছোট দলের’ নেতাদের মধ্যে একজন বা একাধিক জনের ভূমিকা নির্ণায়ক হতে পারে।
রাজ ঠাকরে:
বালাসাহেবের জীবনকালেই ২০০৬ সালে তাঁর প্রিয় ভাইপো রাজ শিবসেনা ত্যাগ করে নিজের দল মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা (এমএনএস) গঠন করেন। বালাসাহেবের নামে কোনও অভিযোগ না করলেও তাঁর পুত্র উদ্ধবের ‘নেতৃত্বগুণ’ নিয়ে গত দেড় দশকে বারবার কটাক্ষ করেছেন রাজ।
এমএনএস গঠনের পর ২০০৯ সালের বিধানসভা নির্বাচনে রাজ নিঃসন্দেহে একটি ফ্যাক্টর ছিলেন। প্রায় ১২ শতাংশ ভোট পেয়ে এবং শিবসেনার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে (তখন বালাসাহেব জীবিত এবং লড়াইয়ের ময়দানে) ১৩টি আসন জিতেছিলেন। মরাঠি অস্মিতার প্রশ্নে তিনি শুধু বিজেপি ও শিবসেনার দুর্গে আঘাত করেননি, ভবিষ্যতের রাজনীতিতে একটি বড় সম্ভাবনা তৈরি করেছিলেন। ২০১২ সালে বৃহন্মুম্বই পুরসভার নির্বাচনে এমএনএস ২৭টি ওয়ার্ড জিতেছিল।
কট্টরপন্থী অবস্থান এবং হিংসাত্মক আন্দোলনের জন্য ক্রমে মরাঠা রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়েন রাজ। ২০১৪ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তাঁর দল বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। মাত্র ৩ শতাংশ ভোট পেয়ে একটি কেন্দ্রে জয়লাভ করে। ২০১৯ সালেও একটি আসন জিতেছিল। তবে চলতি বছরের লোকসভা নির্বাচনে রাজ প্রার্থী না দিয়ে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ-কে নিঃশর্ত সমর্থন করেছিলেন। এবার ১২৫টি আসনে লড়াই করছে তাঁর দল। মুম্বইয়ের ২৫টি এবং রাজ্যের ৩৮টি আসনে তারা ‘ফ্যাক্টর’ হতে পারে। মুম্বইয়ের মাহিম আসনে রাজের পুত্র অমিত লড়ছেন। ভোটের ফল যদি ত্রিশঙ্কু হয় এবং রাজের দল কয়েকটি আসনে জিততে পারে, তবে ‘হিন্দুত্বের’ প্রশ্ন তুলে তিনি বিজেপির সঙ্গী হতে পারেন বলে অনেকে মনে করছেন।
প্রকাশ অম্বেডকর:
বাবাসাহেব অম্বেডকরের পৌত্র এবং মহারাষ্ট্রের প্রভাবশালী দলিত নেতা প্রকাশ অম্বেডকরের দল ‘বঞ্চিত বহুজন অঘাড়ী’ (ভিবিএ) এই বারের বিধানসভা নির্বাচনে ২০০টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। মরাঠওয়াড়া এবং পশ্চিম মহারাষ্ট্রের বিস্তীর্ণ অংশে দলিত জনগোষ্ঠীর উপর তাঁর প্রভাব রয়েছে। পূর্বে তিনি কংগ্রেসের সহযোগী ছিলেন এবং অকোলা থেকে ১৯৯৮ এবং ১৯৯৯ সালে দুই বার লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। তাঁর একক লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত বিজেপি-বিরোধী জোটের জন্য কিছু আসনে ধাক্কা দিতে পারে বলে ভোট বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন।
মহারাষ্ট্রে কংগ্রেস, শিবসেনা (ইউবিটি), এবং এনসিপি (শরদ পওয়ার)-র জোট ‘মহাবিকাশ অঘাড়ী’ (এমভিএ) তরফ থেকে লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রকাশের সাথে বারবার আলোচনা করা হয়েছিল, কিন্তু বিরোধী মহাজোট গঠনের প্রচেষ্টা সফল হয়নি। লোকসভা নির্বাচনের হিসাব অনুযায়ী, প্রকাশ যদি বিরোধী জোটে যোগ দিতেন, তাহলে মহারাষ্ট্রে বিজেপি, শিন্ডেসেনা, এবং অজিত পওয়ারের এনসিপি ‘মহাজুটি’ আরও বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়ত।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে প্রকাশ আসাদউদ্দিন ওয়েইসির ‘অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন’ (মিম) এর সাথে জোট গঠন করেছিলেন। শোলাপুর লোকসভা কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে হেরে গেলেও তিনি এক লক্ষ ৭০ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। এই বার অকোলায় একক শক্তিতে লড়ে তিনি দুই লক্ষ ২৭ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছেন, যা মোট ভোটের ২৩ শতাংশ। অন্যদিকে, সংখ্যালঘু এবং দলিত ভোটের উপর ভর করে মিম অওরঙ্গাবাদ আসনে জয়ী হয়েছিল। এবার যদি প্রকাশের দল নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে, তাহলে ‘ইন্ডিয়া’তে তার যোগদানের সম্ভাবনা বেশি। মহারাষ্ট্রে দলিত ভোটের সংখ্যা প্রায় ১৪ শতাংশ, যার মধ্যে বাবাসাহেবের প্রভাবে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ৭ শতাংশ। প্রকাশের উপর এই ভোটব্যাঙ্কের প্রভাব প্রায় অপরিসীম।
মনোজ জারাঙ্গে পাটিল:
অন্য তিন জনের মতো তিনি পুরদস্তুর রাজনৈতিক নেতা নন। মরাঠাদের জন্য সংরক্ষণের দাবিতে আন্দোলন শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত মনোজ জারাঙ্গে পাটিলের নাম মহারাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষ জানতেন না। এখন তাঁর তুলনা হচ্ছে পাশের রাজ্য গুজরাতের হার্দিক পটেলের সঙ্গে, যিনি ২০১৭-র বিধানসভা ভোটের আগে পাটিদার সংরক্ষণ আন্দোলনকে তুঙ্গে তুলে নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহদের চাপে ফেলেছিলেন।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে মরাঠা সংরক্ষণের দাবিতে অনশন কর্মসূচির পর থেকে মনোজের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। লোকসভা ভোটের আগে তাঁর প্রতিটি কর্মসূচিতে হাজার হাজার মানুষের জমায়েত হয়েছে। সেখানে তিনি মুখ্যমন্ত্রী শিন্ডেকে ক্ষমতাচ্যুত করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, এবং উপমুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীসের বিরুদ্ধে খুনের চক্রান্তের অভিযোগ তুলেছেন।
লোকসভা ভোটে বিদর্ভ, পশ্চিম মহারাষ্ট্র এবং মরাঠওয়াড়ায় বিজেপির জোটের বিপর্যয়ের পেছনে মনোজের ‘ভূমিকা’ গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে রাজনীতির কারবারিদের মত। মহারাষ্ট্রে মরাঠা ভোটারের সংখ্যা প্রায় ৩০ শতাংশ, এবং মনোজের প্রভাব তাদের বড় অংশের উপর রয়েছে। তাঁর ‘গোপন সমর্থনে’ লড়া কয়েক জন নির্দল ও ছোট দলের প্রার্থী এবার ভোটে জিততে পারেন। বিধানসভা ত্রিশঙ্কু হলে মনোজের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
আসাদউদ্দিন ওয়েইসি:
মহারাষ্ট্রের বিধানসভা নির্বাচনে হায়দরাবাদের সাংসদ আসাদউদ্দিন ওয়েইসির দল ‘অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন’ (মিম) ১৪টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে, যার মধ্যে চারটি মুম্বইয়ের এবং বাকি পশ্চিম মহারাষ্ট্রের অওরঙ্গাবাদ ডিভিশনে।
২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে ওয়েইসির দল বাবাসাহেব অম্বেডকরের পৌত্র এবং প্রভাবশালী দলিত নেতা প্রকাশ অম্বেডকরের ‘বঞ্চিত বহুজন আঘাড়ী’ (ভিবিএ) এর সাথে জোট বেঁধেছিল এবং অওরঙ্গাবাদ লোকসভা কেন্দ্রে জয়লাভ করেছিল। সে বছরের বিধানসভা নির্বাচনে ৪৪টি আসনে লড়াই করে দুটিতে জয়ী হয়েছিল এবং প্রায় দেড় শতাংশ ভোট পেয়েছিল।
তবে, এবারের লোকসভা নির্বাচনে ভিবিএ-র সাথে সমঝোতা করে তিনটি আসনে লড়াই করেও শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছে ওয়েইসিকে। অওরঙ্গাবাদ আসনটি শিন্ডসেনার কাছে হারিয়েছে তাঁর দল। এই পরিস্থিতিতে, গত বারের বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় মিম অর্ধেকেরও কম আসনে লড়াই করায়, বিরোধী জোট ‘মহাবিকাশ আঘাড়ী’ কিছুটা সুবিধা পেতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। নির্বাচন-পরবর্তী অনিশ্চয়তা হলেও, মিম বিজেপির সঙ্গী হবে না। তেলঙ্গানায় ‘কট্টর কংগ্রেস বিরোধী’ হিসেবে পরিচিত আসাদউদ্দিন শেষ পর্যন্ত মহাবিকাশ আঘাড়ীকে সমর্থন না করে ‘নিরপেক্ষ’ থাকতে পারেন।