পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের সাফল্য এবং বিজেপির ব্যর্থতার কারণগুলি !
সাত দফায় রাজ্যের ৪২টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ করা হয়েছে, এবং নির্বাচন শুরুর প্রায় দেড় মাস পর মঙ্গলবার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। প্রাথমিক বুথফেরত সমীক্ষায় বিজেপিকে রাজ্যের প্রধান দল হিসেবে দেখানো হলেও ফলাফল ভিন্ন হয়েছে।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল বড় ধাক্কা খেয়েছিল এবং বিজেপির উত্থান ঘটেছিল। তৃণমূল ২২টি আসনে জয়লাভ করেছিল, কিন্তু ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তারা পুনরায় সাফল্য অর্জন করে। এই ধারা লোকসভা নির্বাচনেও অব্যাহত রেখেছে, প্রায় ৩০টি আসনে জয়ের পথে রয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের ভোটের হার গত নির্বাচনের ৪৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪৬ শতাংশ হয়েছে।
বিজেপির নিরাশাজনক ফলাফল
বিজেপি গত লোকসভা নির্বাচনে ১৮টি কেন্দ্রে জয়লাভ করেছিল, ২০১৪ সালের তুলনায় ১৬টি বেশি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দাবি করেছিলেন যে পশ্চিমবঙ্গে তাদের ফলাফল সবচেয়ে ভালো হবে, কিন্তু এই দাবি ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
বিজেপি পূর্ববর্তী বারের তুলনায় প্রায় আটটি আসন কম পেয়েছে এবং তাদের ভোটের হারও অনেক কমেছে। গত লোকসভায় তারা ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, এবার তা ৩৮ শতাংশে নেমে এসেছে। উত্তরবঙ্গে যেখানে বিজেপি তৃণমূলকে পরাজিত করেছিল, সেখানে এবার ঘাসফুল শিবির দুর্গ ভেঙে দিয়েছে।
বাম ও কংগ্রেসের ফিকে প্রদর্শন
বাম ও কংগ্রেস জোট একসঙ্গে ৪০টি কেন্দ্রে লড়াই করেছিল এবং প্রচারে বেশ আলোড়ন তৈরি করেছিল, কিন্তু তারা মাত্র একটি আসনে জয়ী হয়েছে।
গত লোকসভায় বাম ও কংগ্রেস পৃথকভাবে লড়াই করেছিল এবং তারা মোট নয় শতাংশ ভোট পেয়েছিল। বামেরা কোনো আসনে জিতেনি এবং কংগ্রেস দুটি আসনে জয়লাভ করেছিল। এবার একসঙ্গে লড়ে তারা প্রায় ১১ শতাংশ ভোট পেয়েছে, কিন্তু বামেরা এবারও কোনো আসনে জিততে পারেনি এবং কংগ্রেস একটি আসন হারিয়েছে।
লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বড় উলটপুরাণ ঘটেছে। পাঁচবারের সাংসদ এবং প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি অধীর চৌধুরী বহরমপুর কেন্দ্রে পরাজিত হয়েছেন, তাকে হারিয়েছেন প্রাক্তন ক্রিকেট তারকা ইউসুফ পাঠান। মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম আশা জাগিয়েও হেরে গেছেন। মালদহ দক্ষিণ কেন্দ্রে কংগ্রেসের ঈশা খান চৌধুরী জয়লাভ করেছেন।
উত্তরবঙ্গের কোচবিহার কেন্দ্রে বিজেপির নিশীথ প্রামাণিক, যিনি বিদায়ী মন্ত্রিসভায় অমিত শাহের ডেপুটি ছিলেন, তৃণমূলের বিরুদ্ধে হেরে গিয়েছেন। বাঁকুড়া কেন্দ্রে পরাজিত হয়েছেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী সুভাষ সরকার। বালুরঘাট কেন্দ্রে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়েছেন।
কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বিজেপির টিকিটে তমলুক কেন্দ্রে লড়াই করে জয়ের পথে আছেন। কাঁথি কেন্দ্রে অধিকারী পরিবারের দুর্গ অটুট রেখে সৌমেন্দু অধিকারী পদ্ম প্রতীকে জিতেছেন।
আসন পরিবর্তনের পর বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ হেরে গেছেন। তাকে হারিয়েছেন তৃণমূলের প্রার্থী এবং প্রাক্তন ক্রিকেট তারকা কীর্তি আজাদ। আসানসোল কেন্দ্রে বলিউডের প্রাক্তন তারকা এবং তৃণমূলের শত্রুঘ্ন সিনহা বিজেপির প্রার্থী এবং প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুরিন্দর সিং আলুওয়ালিয়াকে হারিয়ে জয়ী হয়েছেন।
তৃণমূল তারকাদের লড়াইয়ে জয়ী হয়েছে। ঘাটাল থেকে দেব এবং হুগলি কেন্দ্র থেকে রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় জিতেছেন। কৃষ্ণনগর কেন্দ্র থেকে মহুয়া মৈত্র ফের লোকসভায় যাচ্ছেন, যিনি কয়েক মাস আগে সংসদ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন।
মতুয়া ভোটের জন্য বনগাঁ কেন্দ্র বিজেপি দখলে রেখেছে, যেখানে তাদের প্রার্থী ছিলেন শান্তনু ঠাকুর, বিদায়ী মন্ত্রিসভার প্রতিমন্ত্রী।
কলকাতার দুই আসনে তৃণমূল এগিয়ে আছে। কলকাতা উত্তরে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপির প্রার্থী হওয়া তাপস রায়কে পিছনে ফেলে এগিয়ে আছেন তৃণমূলের সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। দক্ষিণ কলকাতায় মালা রায় বিপুল জয়ের পথে আছেন।
সিপিএমের টিকিটে লড়াই করা তরুণ বাম প্রার্থীরা প্রচারে সাড়া ফেললেও প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেননি। যাদবপুরে সৃজন ভট্টাচার্য, শ্রীরামপুরে দীপ্সিতা ধর, ডায়মন্ড হারবারে প্রতীক উর রহমান, এবং তমলুকে সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায় পরাজিত হয়েছেন।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় রেকর্ড ভোটে জয়ী
তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রে রেকর্ড সংখ্যক ভোটে জয়লাভ করতে চলেছেন। তিনি সাত লক্ষেরও বেশি ভোটে এগিয়ে আছেন। ২০০৪ সালে অনিল বসু আরামবাগে পাঁচ লক্ষ ৯০ হাজার ভোটে জিতেছিলেন।
বিরোধীরা অভিযোগ করেছেন যে, ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রে ভোটের দিন অধিকাংশ বুথে তাদের এজেন্টদের বসতে দেওয়া হয়নি। ভোট গণনার দিনও বিরোধী এজেন্টদের বসতে দেওয়া হয়নি।
তৃণমূলের জয়ের পেছনের কারণ
তৃণমূলের জয়ের পেছনে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পের বড় অবদান রয়েছে। এই প্রকল্পে নারীরা প্রতি মাসে ৫০০ টাকা পেয়ে থাকেন, যা নির্বাচনের আগে দ্বিগুণ করা হয়েছিল। ভোটের আগে এই টাকা তাদের অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়েছে। দুই কোটিরও বেশি নারী এই প্রকল্পের আওতায় আছেন এবং তাদের ভোট তৃণমূলের পক্ষে গিয়েছে।
বাম ও কংগ্রেস জোট এবং আইএসএফ রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোট আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে প্রায় সমস্ত মুসলমান ভোট তৃণমূলের পক্ষে গিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মুসলমানদের নিয়ে মন্তব্যের ফলে রাজ্যে মেরুকরণ আরো বেড়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী মনে করেন, ভোটের আগে প্রতি তিন জন মানুষের একজন বিজেপির সঙ্গে নেই। সংখ্যালঘুরা পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৩০ শতাংশ। বিজেপি ৭০ নম্বরের পরীক্ষা দিচ্ছে, অথচ তৃণমূল ১০০ নম্বরের পরীক্ষা দিচ্ছে। ২ কোটি ১৮ লক্ষ ভোটার লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের সুবিধা পাচ্ছেন এবং অন্যান্য প্রকল্পও রয়েছে, যা অঙ্ক পরিষ্কার করে দেয়।
বিজেপির হারের কারণ
বিজেপির হারের প্রধান কারণ হিসেবে নেতৃত্ব ও সংগঠনের দুর্বলতা উঠে এসেছে। নিয়োগ দুর্নীতি, একশো দিনের কাজ বা আবাস যোজনায় দুর্নীতির অভিযোগে বড় আন্দোলন গড়ে তুলতে বিরোধীরা ব্যর্থ হয়েছে। সন্দেশখালি নিয়ে যতই তোলপাড় হোক না কেন, ভোটে তা প্রভাব ফেলতে পারেনি। বসিরহাট কেন্দ্রে তৃণমূল বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছে, এবং সন্দেশখালি বিধানসভায় বিজেপি প্রার্থী রেখা পাত্র এগিয়ে যেতে পারেননি।সাংগঠনিক দূর্বলতা তো আছেই,সঙ্গে রয়েছে অযোগ্য ব্যক্তিদের উঁচুপদে আসীন থাকা।এছাড়াও মানুষ এখনো মনে করে মমতা ব্যানার্জী ও অভিষেক ব্যানার্জীকে দূর্নীতির দায়ে জেলে না ঢোকানোর জন্য পেছন থেকে কলকাঠি নাড়াচ্ছে বিজেপি।
বুথফেরত সমীক্ষা যাই বলুক, পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন যে রাজ্যের মানুষ অন্য চিন্তা করেছেন। সাংবাদিক নির্মাল্য মুখোপাধ্যায় বলেন, “মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ ধারণা করা হচ্ছিল, তা তৈরি হয়নি। এখানেই হিসেবে ভুল হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় মানুষের বিশ্বাস ছিল। বিজেপি এখনও পশ্চিমবঙ্গের দল হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। কোথাও একটা কমিউনিকেশন গ্যাপ রয়েছে।”
আগামী দুই বছরে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও পর্যবেক্ষক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মনে করেন যে বিরোধীদের জন্য আশা কম। তিনি বলেন, “আর দুই বছর সময় আছে, কিন্তু বিজেপির ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা কম। প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রচারের পরও যে ফল হয়েছে, তাতে বোঝা যায় তৃণমূলকে হারানো খুবই কঠিন।”