‘মধ্যরাতে রাস্তা দখল’ ‘প্রতীকী’ আন্দোলনের আহ্বান দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে বাংলা জুড়ে !
এটি ছিল কেবলমাত্র ‘প্রতীকী’ আন্দোলনের ডাক। এর পরিসর সীমিত ছিল কলকাতার মাত্র তিনটি স্থানে। তবে, গত ২৪ ঘণ্টায় এই আন্দোলন ধীরে ধীরে গোটা পশ্চিমবঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। দল এবং পতাকা ছাড়াই এই আন্দোলনে অনেক তৃণমূল নেতার পরিবারের মহিলা, আত্মীয় এবং ঘনিষ্ঠজনেরা সাড়া দিচ্ছেন। এই নিয়ে শাসকদল তৃণমূলের মধ্যে উদ্বেগের মেঘ দেখা দিচ্ছে, যা বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে মনে হচ্ছে।
২০০৭ সালে, নন্দীগ্রামে ‘পুনর্দখল’ অভিযান চলাকালীন সিপিএমের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ ওঠে। আলিমুদ্দিন স্ট্রিট, যা ‘অপারেশন সূর্যোদয়’ নামে পরিচিত, তখন নাগরিক সমাজের মিছিলে পরিপূর্ণ ছিল। এই মিছিলে অনেক সিপিএম নেতার সন্তানরাও হাঁটছিলেন। ১৭ বছর পর, প্রশ্ন উঠছে যে সেই বৃত্ত কি সম্পূর্ণ হচ্ছে? সরকার-বিরোধী মিছিলের পরের দিন, সিপিএম নিজেও কলকাতায় একটি নাগরিক মিছিল আয়োজন করেছিল, যদিও সেখানে ভিড় তেমন ছিল না। তৃণমূল মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত কোনো ‘পাল্টা’ কর্মসূচির পরিকল্পনা করেনি।
হুগলির এক তৃণমূল বিধায়কের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী তাঁর এলাকায় স্কুটি চালিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মধ্যরাতে রাস্তায় নামার আন্দোলনের প্রচার করছেন। এই ঘটনায় তৃণমূলের প্রথম সারির নেতারা দ্বিধাগ্রস্ত। ওই দলহীন কর্মসূচিতে তাঁরা কাউকে যেতে বারণ করতে পারছেন না, কিন্তু তাঁরা বুঝতে পারছেন যে গেলে দলের জন্য তা বিড়ম্বনা হবে। কলকাতা পুরসভার ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর সোমা চৌধুরী ফেসবুকে অন্তত ১৪টি জায়গার জমায়েতের পোস্টার পোস্ট করে লিখেছেন, ‘নারীদের সম্মান ও প্রাণ বাঁচাতে দলবদ্ধ হোন।’ মঙ্গলবার মানিকতলা থেকে আরজি কর পর্যন্ত নাগরিক মিছিলে কলকাতা পুরসভার এক তৃণমূল কাউন্সিলরের স্ত্রী পা মিলিয়েছেন। মঙ্গলবারের নাগরিক মিছিলে ছিলেন সমাজকর্মী রত্নাবলী রায়, পিয়া চক্রবর্তী (যিনি অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী), এবং মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়।
হাসপাতালে এক মহিলা চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের অভূতপূর্ব ঘটনার প্রতিবাদে, সামাজিক মাধ্যমে এক আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছিল। আন্দোলনের আয়োজকরা কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য নন। প্রথম পোস্টারটি যা সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল, তাতে ১৪ অগস্ট, বুধবার রাত ১১টা ৫৫ মিনিট থেকে মেয়েদের রাস্তায় নামার আহ্বান করা হয়েছিল। কিন্তু সোমবার রাত থেকে আন্দোলনটি নতুন মাত্রা পেয়েছে এবং মঙ্গলবার তা গোটা বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছে। উত্তর থেকে দক্ষিণ বঙ্গ, বৃহত্তর কলকাতা থেকে বিভিন্ন জেলা শহর এবং মফস্সল পর্যন্ত এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন এলাকায় মহিলারা নিজেদের মতো করে এই আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছেন এবং জমায়েত করতে উদ্যোগী হয়েছেন।
আন্দোলনের প্রাথমিক ডাকে কলেজ স্ট্রিট, অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস, এবং যাদবপুর এইটবি বাস স্ট্যান্ডকে জমায়েতের স্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তবে, সোমবার রাত থেকে উত্তরপাড়া শখের বাজার, সোদপুর বিটি রোড মোড়, চন্দননগর স্ট্র্যান্ড, কৃষ্ণনগর পোস্ট অফিস মোড়ে মেয়েদের দখলের পোস্টার ছড়িয়ে পড়ে। আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের ইস্তফা দেওয়া অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত করার নির্দেশের পর থেকে মধ্যরাতে রাস্তা দখলের আন্দোলনের আহ্বান সমাজমাধ্যমে ছড়াতে থাকে। মঙ্গলবার বর্ধমান শহরের কার্জন গেট, দুর্গাপুরের সিটি সেন্টার, রায়গঞ্জ, শিলিগুড়ি, মালদহ শহর, বহরমপুর, মেদিনীপুর, পুরুলিয়া শহর, ব্যান্ডেল, শ্রীরামপুর সহ মফস্সল শহরের মহিলারা এই আন্দোলনে যোগ দেন।
কলকাতা হাই কোর্টের সিবিআই তদন্তের নির্দেশ এবং সন্দীপ ঘোষের বিষয়ে নির্দিষ্ট নির্দেশনা প্রদানের পাশাপাশি, পড়ুয়াদের আন্দোলনের সমস্ত দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। এর ফলে চিকিৎসকদের উচিত পরিষেবা পুনরায় চালু করা। অন্যথায়, সাধারণ মানুষ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন প্রদান করবে না। ‘দেশ বাঁচাও গণ মঞ্চ’ মঙ্গলবারের এক বিবৃতিতে বলেছে যে, তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীন হাসপাতালগুলি চালু রাখা উচিত। হাসপাতালে আসা মানুষ যেন চিকিৎসা না পেয়ে অসহায় মৃত্যুবরণ না করেন। চিকিৎসকদের শপথ হল সাধারণ রোগীদের সেবা করা। তবে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন যে তাদের কর্মবিরতি অব্যাহত থাকবে।
বিভিন্ন মত রয়েছে ‘মেয়েরা রাত দখল করো’ আন্দোলনের ফর্ম নিয়ে। যাদবপুরের জমায়েতে রাজনৈতিক সংগঠনের পতাকা নিষিদ্ধ, অন্যত্র রাজনৈতিক স্লোগান নিষিদ্ধ। আরজি কর-কাণ্ডে নিহত চিকিৎসকের জন্য ন্যায়বিচার এবং মহিলাদের নিরাপত্তার দাবিতেই স্লোগান সীমিত রাখা উচিত। কিছু মহিলা চান শুধু মহিলারাই জমায়েতে অংশ নিক, পুরুষদের নয়। অন্য অংশ মনে করে, নির্যাতনের বিরুদ্ধে মহিলাদের পাশে দাঁড়ানো পুরুষদের সরিয়ে দেওয়া আন্দোলনের পরিসর সঙ্কুচিত করে।
বামপন্থীরা মধ্যরাতে মেয়েদের রাস্তা দখলের ঘটনাকে সরাসরি ‘রাজনৈতিক’ কর্মসূচি হিসেবে দেখছে। এর ফলে, সিপিএমের একাংশ সামাজিক মাধ্যমে লিখছে, ‘আরজি কর কাণ্ড যতই তৃণমূলের দিকে ইশারা করুক না কেন, ততই আন্দোলনকে অরাজনৈতিক করার চক্রান্ত শুরু হয়েছে।’ সিপিএমের ছাত্র-যুব সংগঠন এসএফআই এবং ডিওয়াইএইআই বুধবার মধ্যরাতে আরজি কর হাসপাতালের সামনে জমায়েতের আহ্বান জানিয়েছে। অন্যদিকে, সিপিএমের অন্য একটি অংশ চাইছে জেলায় জেলায় ‘ঝান্ডাহীন’ হয়ে নাগরিক আন্দোলনে দলের কর্মী-সমর্থকরা যোগ দিন। কিছু সিপিএম কর্মী বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের স্লোগানকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছেন। সামাজিক মাধ্যমে কিছু সিপিএম সদস্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবির পাশে আগুন ধরানোর ছবি দিয়ে ‘দফা এক, দাবি এক, মমতার পদত্যাগ’ লিখেছেন, যেমনটি বাংলাদেশে ‘দফা এক, দাবি এক, হাসিনার পদত্যাগ’ লেখা হয়েছিল।