ভারতে নাগরিকত্ব পেতে ব্যর্থ হয়ে পাকিস্তানে ফিরে গেছেন প্রায় ৮০০ হিন্দু শরণার্থী। ভারতের বেসরকারি সংস্থা সীমান্ত লোক সংগঠন (এসএলএস) এ কথা জানিয়েছে। এ অবস্থায় অনলাইন আবেদন প্রক্রিয়াটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এসএলএস জানিয়েছে, ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে নাগরিকত্ব পেতে প্রায় ৮০০ হিন্দু ভারতে এসেছিলেন। পরে রাজস্থান থেকে তারা প্রতিবেশী দেশটিতে ফিরে যান।এ সংগঠন ভারতে পাকিস্তানি সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কাজ করে থাকে। তারা জানায়, নাগরিকত্ব আবেদনে কোনো অগ্রগতি না দেখে তাদের অধিকাংশই পাকিস্তানে ফিরে যান।
এসএলএস সভাপতি সিং সোধা বলেন, হিন্দু শরণার্থীরা সেখানে ফিরতেই ভারতের বদনাম করতে তাদের কাজে লাগায় পাকিস্তানি সংস্থাগুলো। তাদের গণমাধ্যমের সামনে আনা হয়। তাদের দিয়ে বলানো হয়, ভারতে তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়েছে।
অনলাইনে নাগরিকত্ব আবেদনের এ প্রক্রিয়া ২০১৮ সালে শুরু করে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে সাতটি রাজ্যে ১৬ ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টরকে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে নিপীড়িত হিন্দু, খ্রিষ্টান, শিখ, পারসি, জৈন ও বৌদ্ধদের করা অনলাইন নাগরিকত্ব আবেদন গ্রহণ করতে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তদুপরি ২০২১ সালের মে মাসে গুজরাট, ছত্তিশগড়, রাজস্থান, হরিয়ানা ও পাঞ্জাবে আরও ১৩ ডিএম কে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের ৫ ও ৬ নম্বর ধারার অধীন হিন্দু, খ্রিষ্টান, শিখ, পারসি, জৈন ও বৌদ্ধদের আবেদনে নাগরিকত্ব সনদ দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়।
পুরো প্রক্রিয়াটি অনলাইনে সম্পন্ন হচ্ছে। কিন্তু মেয়াদোত্তীর্ণ পাসপোর্ট অনলাইনে গ্রহণ করা হচ্ছে না। এতে বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে পাসপোর্ট নবায়ন করতে দিল্লিতে পাকিস্তান হাইকমিশনে ছুটতে বাধ্য হন শরণার্থীরা।
সিং সোধা বলেন, যদি কোনো পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১০ হয়, তাহলে পাকিস্তান হাইকমিশনে পাসপোর্ট নবায়ন করতে তাদের এক লাখ রুপির বেশি খরচ হয়। কঠিন দারিদ্র্যের মধ্যে থাকা এই মানুষেরা ভারতে এসেছেন। এত টাকার চাপ সামলানো তাদের সামর্থ্যের বাইরে।
সিং সোধা আরও বলেন, অনলাইনে আবেদনের পাশাপাশি ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টরদের কাছে সশরীরেও কাগজপত্র জমা দিতে হয়। এটা আবেদনকারীদের জন্য বাড়তি বিড়ম্বনা। অবশ্য অনলাইন আবেদন প্রক্রিয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
অনলাইন তথ্যের বরাত দিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর রাজ্যসভাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবহিত করেছে, ১৪ ডিসেম্বর নাগাদ নাগরিকত্বের ১০ হাজার ৬৩৫টি আবেদন মন্ত্রণালয়ে অনিষ্পন্ন ছিল। এসব আবেদনের ৭ হাজার ৩০৬টি ছিল পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের।
তবে সিং সোধার দাবি, কেবল রাজস্থানেই নাগরিকত্বের অপেক্ষায় রয়েছেন ২৫ হাজার পাকিস্তানি হিন্দু। তাদের অনেকেই দুই দশকের বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করছেন। তাদের অনেকেই সশরীরে আবেদন করেছেন।
২০১৫ সালে নাগরিকত্ব বিধিতে সংশোধন আনে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এই ছয় সম্প্রদায়ের বিদেশি অভিবাসীদের যারা ২০১৪ সালের ডিসেম্বর অথবা এর আগে ভারতে এসেছেন, তাদের অবস্থান করার সুযোগ করে দেওয়া হয় এবং পাসপোর্টের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলেও তাদের পাসপোর্ট ও ফরেনার আইন থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়।
যারা ভারতে শরণার্থী হওয়ার আবেদন করেছেন, তারা হয়তো দীর্ঘমেয়াদি ভিসা (এলটিভি) অথবা পুণ্যার্থী ভিসায় এসেছেন। দীর্ঘমেয়াদি ভিসা দেওয়া হয় পাঁচ বছরের জন্য। এটা নাগরিকত্ব দেওয়ার পূর্ববর্তী পদক্ষেপ।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১-১৪ সাল নাগাদ পাকিস্তানি হিন্দুদের দীর্ঘমেয়াদি ভিসার সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১৪ হাজার ৭২৬। গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আরও ছয় শতাধিক পাকিস্তানি হিন্দুকে দীর্ঘমেয়াদি ভিসা দেওয়া হয়েছে বলে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। সরকার ২০১৮-২১ সাল নাগাদ প্রতিবেশী তিনটি দেশ থেকে ছয় সম্প্রদায়ের সদস্যদের কাছ থেকে ৮ হাজার ২৪৪টি নাগরিকত্বের আবেদন পায়।
২০১৪ সালের আগে প্রতিবেশী তিনটি দেশ থেকে ভারতে আসা নিপীড়িত ছয়টি সম্প্রদায়ের অনথিভুক্ত (অবৈধ) অভিবাসীদের সুবিধা দিতে ২০১৯ সালে নাগরিক সংশোধনী আইন (সিএএ) করা হয়। তবে এ-সংক্রান্ত বিধানগুলো এখনো মন্ত্রণালয় রূপরেখা তৈরী করতে না পারায় আইনটি এখনো কার্যকর হয়নি।
সংখ্যালঘু অভিবাসীদের আবেদন দ্রুত নিষ্পন্ন হওয়ার ক্ষেত্রে সিএএ কাজে লাগত। এতে নাগরিকত্ব পেতে ভারতে বাধ্যতামূলক ১১ বছর অবস্থান করার শর্ত শিথিল করে পাঁচ বছর করা হয়েছিল। যদিও নাগরিকত্বের জন্য অপেক্ষমাণ অনেকেই বৈধভাবে এসেছেন এবং ১১ বছরের বেশি সময় ভারতে অবস্থান করছেন।
এদিকে ভারতে শরণার্থী হয়ে আসা পাকিস্তানি হিন্দুরা কেন ফিরে যেতে বাধ্য হলেন। এই প্রশ্ন তুলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি দিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী। উল্লেখ্য, সম্প্রতি ৮০০ জন পাকিস্তানি হিন্দু ভারত থেকে ফের পাকিস্তানে ফিরে গেছেন। এই খবর প্রকাশ্যে আসার পরই এবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে চিঠি দিলেন অধীরবাবু।
২০১৮ সালেই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন কার্যকর না হলেও পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দু, শিখ, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, জৈন শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার অনলাইনে আবেদনের ব্যবস্থা করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। দেশের ৭ রাজ্যে এই ব্যবস্থা চালু হয়। কিন্তু তারপরও অনেকেই নাগরিকত্ব পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার পরই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে চিঠি লেখেন অধীর। চিঠিতে পাকিস্তানি হিন্দুদের অবস্থা কতটা করুন, সেই কথা উল্লেখ করা হয়েছে। চিঠিতে অধীর চৌধুরী আবেদন করেন, হতাশ হয়ে পাকিস্তানি হিন্দুদের যেন ফিরে যেতে না হয়, সেই বিষয়টি যেন কেন্দ্রীয় সরকার দেখেন।