বছরের শেষভাগ থেকেই সীমান্তে অশান্ত বেড়েছে। একদিকে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের উৎপাত, অন্যদিকে মৌলবাদীদের ভারতের বিভিন্ন অংশ দখলের হুমকি। সীমান্তরক্ষী বাহিনী থেকে সেনা পর্যন্ত, সবার চিন্তা বেড়েছিল। তবে গোয়েন্দাদের রিপোর্ট ঘুম উড়িয়ে দিয়েছিল। তাতে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছিল যে, অশান্তির আবহেই ভারতের অরে শিকড় মজবুত করছে ইসলামিক জঙ্গি সংগঠন, এবং তাদের মূল নিশানা পশ্চিমবঙ্গ। ফেব্রুয়ারিতে এসে উদ্বেগ বেড়েছে মাও বাদীদের নিয়ে। ছত্তীসগঢ়ে যখন মাওবাদী নিধনযজ্ঞ চলছে, তখনই বাংলায় নাকি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে মাওবাদ। ইসলামিক জঙ্গি থেকে মাওবাদ – বাংলা নিয়েই উদ্বেগ কেন্দ্রের। তবে কি মমতা ব্যানার্জীর বাংলাই কি সফট টার্গেট হয়ে উঠছে জঙ্গিদের নাকি বাংলাই সন্ত্রাসীদের নিশ্চিত ঠিকানা?
২৮টি কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য গোয়েন্দা সংস্থার কমন প্ল্যাটফর্ম মাল্টি এজেন্সি সেন্টার (Multi Agency Center)। দিন কয়েক বাদেই এই গোয়েন্দা সংগঠনের বৈঠক রয়েছে। সেই বৈঠকের আগে কলকাতায় দু’দিনের সফরে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। বৈঠক করলেন শীর্ষ গোয়েন্দা কর্তাদের সঙ্গে। বাংলা নিয়ে প্রকাশ করেছেন একাধিক উদ্বেগ। কী সেই উদ্বেগ?
আনসারুল্লা বাংলা টিম থেকে শুরু করে জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের মতো জঙ্গি সংগঠনের এই রাজ্যে বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে। সম্প্রতি অসম এবং বাংলা মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত ১৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অসমের কোকরাঝাড়ে আনসারুল্লা বাংলার ডেরায় মিল রাইফেল টাইমার বোমা বানানোর সরঞ্জাম, তার-সুইচ, কারতুজ , স্প্লিন্টারসহ বোমা বানানোর যাবতীয় সামগ্রী।জঙ্গি নাশকতা চালাতেই এই সামগ্রী কী উদ্দেশ্যে মজুত করা হচ্ছিল।
- আরও পড়ুন –‘সতর্ক করে রাখছি…’, দায়িত্ব পেয়েই চরম হুঁশিয়ারি FBI-এর নতুন ডিরেক্টর কাশ্যপ প্রমোদ প্যাটেলের!
এানেই প্রশ্ন, পড়শি দেশের জঙ্গি সংগঠনগুলি। স্থানীয় স্তরে এই সংগঠনগুলির বিস্তারে কারা সাহায্য? কোন কোন ওভারগ্রাউন্ড সংগঠন এদের অর্থ এবং লজিস্টিক সাপোর্ট দিচ্ছে? পাক গুপ্তচর সংস্থার গোয়েন্দাদের এই রাজ্যে আনাগোনা নিয়েও অজিত দোভাল সতর্কবার্তা দিয়েছেন গোয়েন্দাদের।
আনসারুল্লার ‘সেফ হেভেন’ কি বাংলা? গোয়েন্দা সূত্রের খবর, বাংলাকে আইএসআই (ISI)-এর ট্রানজিট করিডর হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে। তাই আরও সতর্ক প্রয়োজন। খতিয়ে দেখা হচ্ছে, স্থানীয় স্তরে আইএসআই-র নেটওয়ার্কে পরোক্ষভাবে কেউ জড়িয়ে পড়ছে কি না। এর পাশাপাশি প্রতিটি অনুপ্রবেশের ঘটনা ভালোভাবে খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন দোভাল।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অস্থিরতার সুযোগে অনেক বাংলাদেশি বৈধ এবং অবৈভাবে এই রাজ্যে বসবাস করছে। সেই ভিড়ে ইসলামিক জঙ্গি সংগঠনের নেতৃত্ব এবং আইএসআই অপারেটিভ মিশে থাকতে পারে বলেই অনুমান। এক্ষেত্রে বীরভূম মালদহ মুর্শিদাবাদ এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার মতো সীমান্তবর্তীাগুলিতে বিভিন্ন অনথিভুক্ত মাদ্রাসা এবং কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় কিছু সামাজিক সংগঠনের।
আনসারুল্লা বাংলা টিমের স্লিপার সেলগুলি জাগিয়ে তোলা হচ্ছে বলে সন্দেহ গোয়েন্দাদের। অনুমান করা হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে ভারতের পূর্ব ও উত্তর-পূর্বকে নিশানা করে ছক তৈরি করা হচ্ছে। বাংলাদেশের অশান্তির আবহে ভারতকে নিশানা করে কোনও পরিকল্পনা করা হচ্ছে? এই বিষয়ে সমস্ত রাজ্যের পুলিশ তথা গোয়েন্দাদের সতর্ক করা হয়েছে।
যখন বাংলা ও অসম জঙ্গি ধরা পড়ছে, তখন অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেছেন, “আনসারুল্লা বাংলা টিম কোনও সাধারণ সংগঠন নয়, এদের কাছে অনেক আধুনিক প্রযুক্তির ডিভাইস রয়েছে। আর সেগুলি ধরা বেশ কঠিন!”
গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী, অনেকদিন আগে থেকেই আনসারুল্লা বাংলার নিশানায় ছিল ভারত। ২০২২ থেকে এই ‘আনসুল্লা বাংলা টিম’-এর পাশে রয়েছে লস্কর-ই-তৈবা। তাদের একটাই উদ্দেশ্য, ভারতের উত্তর-পূর্ব অংশকে তছনছ করে দেওয়া। ২০২২-এর একটি গোয়েন্দা রিপোর্টেও জানা যায় যে, ত্রিপুরায় কর্মকাণ্ড চালাতে অন্ত ৫০ থেকে১০০ জঙ্গি রয়েছে।
একদিকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের মতো জঙ্গি সংগঠনগুল মাথাব্যথা তো রয়েছেই, তার ওপর মাওবাদীরা গোঁদের ওপর বিষফোঁড়া হয়েেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, শীর্ষ মাওবাদী নেতৃত্ব এই্যে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ মাওবাদ মুক্ত করার শপথ নিয়েছেন। সেই লক্ষ্যেই ছত্তীসগড়ে একের পর এক মাওবাদ বিরোধী অপারেশন চালানো হচ্ছে। সম্প্রতি কয়েকটি অভিযানেই প্রায় শতাধিক মাওবাদী নিকেশ করা হয়েছে এবং ধরা পড়েছে মাওবাদী শীর্ষ নেতারাও। কার্যত অনেকটাই কোণঠাসা মাওবাদীরা। এই পরিস্থিতিতে বাংলা তাদের আশ্রয় হয়ে উঠেছে।
গোয়েন্দাদেরা, একাধিক শীর্ষ মাওবাদী নেতা, যাদের মধ্যে পলিটব্যুরো সদস্যও রয়েছেন, তারা এই রাজ্যে আশ্রয় নিয়েেছেন। এ রাজ্যে প্রকাশ্যে মাওবাদ কার্যকল অনেকটা স্তিমিত হলেও, তাদের অনেক সমর্থক রয়েছেন। তাদের আশ্রয়েই শীর্ষ মাওবাদী নেতারা লুকিয়ে থাকছেন,এর সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না গোয়েন্দারা।
সম্প্রতি ইন্দ্রবতী জাতীয় অরণ্যে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে ৩১ মাওবাদী গেরিল মৃত্যু হয়েছে তাদের মধ্যে ছিলেন হাঙ্গা কর্মা , মাওবাদীদের ডিভিশনাল কমান্ডার পর্যায়ের নেতা। গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, কর্মা ২০১২ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত বছর কলকাতায় লুকিয়ে ছিলেন। মনে করা হচ্ছে, দেবজী, কটকম সুদর্শন এর মতো মাওবাদী শীর্ষ নেতারাও এই রাজ্যে লুকিয়ে থাকতে পারে।
কলকাতা এবং এই রাজ্যের মাওবাদী সমর্থকদের সাহায্যে সংগঠনের পুনর্গঠন এবং লজিস্টিক সংগ্রহের পরিকল্প করতে পারে মাওবাদীরা।
মাল্টি এজেন্সি সেন্টারের বৈঠকের আগে অজিত ডোভালের এই বাংলা সফর জাতীয় নিরাপত্তার দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ থেকেই এই বিশেষ সফর, এমনই ইঙ্গিত কেন্দ্রীয় গোয়েন্দার ।