প্রকাশ্যে এলো শেখ হাসিনার ভয়ঙ্কর জেল ‘আয়নাঘর’ এর কাহিনী!বিরোধীদের তুলে এনে অত্যাচার করা হতো এখানে!
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক গণবিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর, ‘আয়নাঘর’ নামক একটি শব্দ সামাজিক মাধ্যম থেকে সংবাদ মাধ্যমে প্রচলিত হতে শুরু করেছে। এই শব্দটি যেভাবে সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে, তার পেছনে যেন অবিশ্রান্ত ঘৃণা এবং ভীতি লুকিয়ে আছে। ‘আয়নাঘর’ আসলে কী?
‘আয়নাঘর’ মূলত আওয়ামী আমলের ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই) দ্বারা পরিচালিত একটি গোপন বন্দিশালা। এটি শেখ হাসিনার শাসনকালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং সাধারণত সরকার-বিরোধী চক্রান্তে জড়িত সন্দেহভাজনদের আটকে রাখা হতো। উল্লেখ্য, ডিজিএফআই হলো সে দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি গোয়েন্দা সংস্থা।
৬ অগস্ট তারিখে, ব্যারিস্টার আহমেদ বিন কাসেম আরমান এবং প্রাক্তন সেনা আধিকারিক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী আট বছর ধরে নিখোঁজ থাকার পর প্রকাশ্যে এসেছেন। তাঁরা বলেছেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের ‘মানবতা বিরোধী’ কার্যকলাপের জন্য শেখ হাসিনা সরকার তাঁদের ‘আয়নাঘর’ নামক স্থানে আটকে রেখেছিল, এমনটি তাঁরা বাংলাদেশের ‘ডেলি অবজ়ার্ভার’ সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন।
আরমান এবং আযমী উভয়েই জানিয়েছেন যে তারা আট বছর ধরে বিনা বিচারে এক নিকৃষ্ট অবস্থায় বন্দি ছিলেন।
৫ অগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যান। এরপর থেকে ‘আয়নাঘর’ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। জানা গেছে, হাসিনা শাসনামলে অনেকেই হঠাৎ নিখোঁজ হয়েছিলেন। তাঁরা সকলেই আওয়ামী সরকারের বিরোধী ছিলেন এবং প্রকাশ্যে হাসিনার সমালোচনা করতেন। নাৎসি জমানার জার্মানিতে বিরোধীদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে রাখার মতোই, ‘আয়নাঘর’ চালু ছিল বলে সেখান থেকে মুক্তি পাওয়া বন্দিরা জানিয়েছেন।
ঢাকা শহরে নাকি ২৩টি বন্দিশালা ছিল, যার মধ্যে ‘আয়নাঘর’ অন্যতম। মানবাধিকার সংস্থাগুলির সমীক্ষা মতে, ২০০৯ সালে প্রায় ৬০০ জন ব্যক্তি রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়েছেন, যাদের বলপূর্বক অপহরণ করা হয়েছিল। এই সব অপহরণের পেছনে সেনাবাহিনীর হাত থাকার অভিযোগ উঠেছে।
বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার অভিযোগ অনুযায়ী, কেবল তৎকালীন সরকারের সমালোচনাকারীরাই নয়, ‘চরমপন্থী’ বা ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে চিহ্নিত অনেক ব্যক্তিকেও ‘আয়নাঘর’ নামক বা তার মতো গোপন বন্দিশালায় আটক করা হয়েছিল। এদের মধ্যে কিছু ব্যক্তিকে পরবর্তীতে মুক্তি দেওয়া হয়, কিছুকে সেনাবাহিনী হত্যা করে, এবং খুব কম সংখ্যক ব্যক্তিকেই বিচারের জন্য আদালতে প্রেরণ করা হয়।
সুইডেনের সংবাদমাধ্যম ‘নেত্র নিউজ়’, যা মূলত বাংলাদেশের খবর প্রকাশ করে, ২০২২ সালের ১৪ অগস্ট একটি তদন্তমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। প্রতিবেদনে প্রথম উল্লেখ করা হয় যে ‘আয়নাঘর’ নামের একটি গোপন কারাগারে হঠাৎ নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের আটক এবং নির্যাতন করা হচ্ছে। ‘নেত্র নিউজ়’ ঐ কারাগারের সম্ভাব্য অবস্থান সম্পর্কেও তথ্য দিয়েছিল। হাসিনুর রহমান এবং শেখ মোহাম্মদ সেলিমের বয়ানের ভিত্তিতে এই দাবি করা হয়েছিল, যারা নিজেদেরকে ‘আয়নাঘর’ এ আটক থাকার কথা বলেছেন।
২০১৮ সালের ৮ অগস্ট, বাংলাদেশের প্রাক্তন সেনা আধিকারিক এবং র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের সদস্য হাসিনুরকে তাঁর মিরপুরের বাসা থেকে ১৪-১৫ জন লোক অপহরণ করে। ২০২২ সালে, তাঁকে তাঁর নিজের বাড়ির সামনে ফিরিয়ে আনা হয়, সে সময় তিনি অসুস্থ ছিলেন, তাঁর কথাবার্তা অসংলগ্ন এবং উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন। হাসিনুর জানিয়েছেন, তাঁকে ১৬ মাস ধরে ‘আয়নাঘরে’ আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়েছিল। চট্টগ্রামে জামাত-উল-মুজাহিদিনের বেশ কয়েকজন সদস্যকে ২০০৫-০৬ সালে হাসিনুর গ্রেফতার করেছিলেন, যারা নাশকতার কাজে জড়িত ছিল। তবুও, ‘দেশদ্রোহিতা’র অভিযোগে তাঁকে সেই সময় পদচ্যুত করা হয়।
‘নেত্র নিউজ’ কিছু কারাগারের ছবি প্রকাশ করে এবং দাবি করে যে সেগুলি ‘আয়নাঘর’ নামক স্থানের। তারা আরও বলে যে সেই ছবিগুলি সেখানকার সামরিক অধিকারীরা তুলেছেন। এটি দাবি করা হচ্ছে যে, বাংলাদেশের কাউন্টার-টেররিজ়ম ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো এবং ডিজিএফআই ‘আয়নাঘর’-এর দায়িত্বে আছে। ‘নেত্র নিউজ’ আরও জানিয়েছে যে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের একটি ভবনে এই গোপন কারাগারটি অবস্থিত।
‘নেত্র নিউজ়’ এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে যা রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার বিভাগের প্রধান মিশেল ব্যাশেলেটের বাংলাদেশ সফরের আগে। মিশেল ঢাকায় পৌঁছে হঠাৎ নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন এবং দেশে ফেরার আগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে এই নিরুদ্দেশ ঘটনাবলীর উপর তার মতামত প্রকাশ করেন। এছাড়াও, তিনি আইন-বহির্ভূত হত্যা এবং নিখোঁজ ব্যক্তিদের বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানান।
মীনাক্ষী গঙ্গোপাধ্যায়, মানবাধিকার নিয়ে কর্মরত ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ নামক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র, দাবি করেছেন যে বাংলাদেশ সরকার ব্যক্তিদের নিখোঁজ হওয়ার জন্য দায়ী। এই দাবির সমর্থনে, নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবার নিয়ে গঠিত ‘মায়ের ডাক’ নামের মঞ্চ একটি মিছিল আয়োজন করে। মঞ্চের আহ্বায়ক সানজিদা ইসলাম, ডিজিএফআই-এর বিরুদ্ধে গোপন বন্দিশালা পরিচালনার অভিযোগ আনেন, যা ‘আয়নাঘর’ দিকে ইঙ্গিত করে।
শেখ মোহাম্মদ সেলিম, এক প্রাক্তন সামরিক অফিসার, ফোনে ডাকা হয়েছিল এবং ‘আয়নাঘর’ নামক একটি জায়গায় আটকে রাখা হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। তিনি দাবি করেন যে, তাকে ওই বন্দিশালায় দীর্ঘ বছর ধরে আটকে রাখা হয়েছিল। ‘নেত্র নিউজ়’ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারে যে, সেই কারাগারের কক্ষগুলোতে কোনো জানালা ছিল না। শুধুমাত্র অনেক উঁচুতে একটি ছোট বাল্ব থেকে কিছু আলো পাওয়া যেত। একটি বিশাল এগ্জ়স্ট ফ্যান সারাদিন চলত এবং তার শব্দে বাইরের কোনো শব্দ কারাগারের ভেতরে পৌঁছাত না। মাঝে মাঝে তিনি কম্পন অনুভব করতেন, যা থেকে তার অনুমান ছিল যে কাছাকাছি কোনো বিমানবন্দর বা বিমানঘাঁটি অবস্থিত।
সেলিম ‘নেত্র নিউজ়’কে বলেছিলেন যে, সেখানে কতজন বন্দি ছিলেন তা তাঁর জানা নেই। তাঁকে প্রায়ই মারধর করা হত এবং অন্যান্য শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হত। একদিন তাঁকে প্রচণ্ডভাবে মারধর করা হয় এবং অন্য একটি ঘরে ফেলে রাখা হয়। পরবর্তীতে জানা যায়, ডিজিএফআই সেলিমকে তুলে আনার উদ্দেশ্য রাখেনি, ভুলবশত তাঁকে তুলে আনা হয়েছিল। পরে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং তিনি মালয়েশিয়া পাড়ি জমান।
জানা গেছে, ৭ অগস্ট ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের নেতা মাইকেল চাকমা ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্তি পেয়েছেন। মাইকেল চাকমা ২০১৯ সালের এপ্রিল মাস থেকে নিখোঁজ ছিলেন। তাঁর আইনজীবী, জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, তাঁর সন্ধানের জন্য আদালতে হেবিয়াস কর্পাস পিটিশন দাখিল করেছিলেন। তিনি সংবাদমাধ্যমকে মাইকেলের বাড়ি ফেরার খবর সত্য বলে নিশ্চিত করেছেন।
এক সামরিক অফিসার ‘নেত্র নিউজ়’কে বলেছিলেন যে ‘আয়নাঘর’-এ প্রায় ৩০টি কক্ষ ছিল। সেলিম ‘ভয়েস অফ আমেরিকা’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, যদিও প্রতিটি কক্ষ শব্দনিরোধক ছিল, তবুও প্রায়ই সেই ঘরগুলি থেকে দুর্বল আর্তনাদ শোনা যেত। মাঝে মাঝে কাউকে ‘আয়নাঘর’ থেকে ছেড়ে দেওয়া হলেও, পরবর্তীতে তারা এ বিষয়ে চুপ থাকতেন এবং ধরপাকড়ের ভয়ে তাদের পিছু নিত।
সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে ‘আয়নাঘর’ নিয়ে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে। অনেক নিখোঁজ ব্যক্তির পরিবার আশা করছেন যে তাদের প্রিয়জনরা ফিরে আসবেন। ডিজিএফআই ৭ অগস্ট সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছে যে বর্তমানে আর কোনো ব্যক্তি আটক নেই। ২০১১ সালে মাদারিপুরের আতাউর রহমান নিখোঁজ হন। ‘ডেলি স্টার’ পত্রিকাকে তার স্ত্রী নাদিরা সুলতানা জানান, তিনি ঢাকায় যাচ্ছেন তার স্বামীকে ফিরিয়ে আনার জন্য। নাদিরা সুলতানার মতো অনেকেই নিখোঁজ পরিজনদের ফিরে আসার অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু তাদের সবাই জীবিত আছেন কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে।