শুল্ক নিয়ে হুমকি-ধমকি এবং চাপ সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা যেন এখন সম্পূর্ণ উল্টোফলে রূপান্তরিত হয়েছে, এবং তা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিকেই বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে। এক কথায়, নিজেই নিজের জালে আটকে পড়ছেন তিনি। এই জটিল পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তিনি তড়িঘড়ি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে আলোচনা করে বিবাদ মেটানোর চেষ্টা করছেন। তবে শোনা যাচ্ছে, ‘বিশ্বাসঘাতক বন্ধু’র ফোন গ্রহণ করতে রাজি নন মোদী। ভারতীয় অর্থনীতির প্রতি অপমানের প্রতিশোধ হিসেবেই কি এমন মনোভাব? এই বিষয়টি নিয়ে বিশ্বজুড়ে নানা রকম জল্পনা-কল্পনা চলছে।
চলতি বছরের ২৭ অগস্ট থেকে ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ শুরু করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম, বিরল খনিজ এবং সেমিকন্ডাক্টরের মতো সামগ্রী ছাড়া অন্য সব পণ্য এই শুল্কের আওতায় পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে নিয়ে জার্মান গণমাধ্যম ‘ফ্রাঙ্কফুর্টার অ্যালজ়েমেইন জ়েইতুং’ (এফএজ়েড) একটি বিস্ফোরক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যা বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তবে নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটন থেকে এখনো পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
এফএজ়েডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অন্তত চার বার মোদীকে ফোন করেছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কোনও বারই ফোন ধরেননি। এর ফলে ভারতের ক্ষেত্রে ট্রাম্পের শুল্ক-হুমকি এবং চাপ দিয়ে কাজ হাসিলের কূটকৌশল পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। জার্মান ভাষায় লেখা ওই রিপোর্টে ট্রাম্প কোন তারিখে মোদীর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন, তা উল্লেখ করা হয়নি। তবে বিশ্বস্ত সূত্রের মাধ্যমে গোটা বিষয়টি জানা গিয়েছে বলে দাবি করেছে ওই ইউরোপীয় সংবাদমাধ্যম।
- আরও পড়ুন এখানে – ভারত থেকে তেল কিনতে সমস্যা থাকলে কিনবেন না, আমরা জোর করছি না, আমেরিকাকে পাল্টা বার্তা জয়শঙ্করের!
মোদীর তরফ থেকে ট্রাম্পের ফোন না ধরার পিছনে একাধিক কারণ উল্লেখ করেছে ‘ফ্রাঙ্কফুর্টার’। এই প্রসঙ্গে জার্মান সংবাদমাধ্যমটি ভিয়েতনামের উদাহরণ দিয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে হ্যানয়ের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছিল ওয়াশিংটন। জুলাই মাসে এই বিষয়ে ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন ট্রাম্প। তারপর, দু’পক্ষের যাবতীয় গোপন কথা তিনি নিজের সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ ফাঁস করে দেন ট্রাম্প।
ট্রাম্পের পোস্টের কারণে ভিয়েতনাম বেশ চাপে পড়ে যায়। কারণ, তখনও দু’পক্ষের মধ্যে কোনও সরকারি বাণিজ্যচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। তবে গণমাধ্যমে এই বিষয়ে খবর ছড়াতে শুরু করে। কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প অতীতেও বহুবার এই ধরনের কৌশল ব্যবহার করেছেন, যাতে বাণিজ্যচুক্তির যাবতীয় সুবিধা নিজের পক্ষে নিয়ে আসা যায়। আর এই কারণেই মোদী ইচ্ছাকৃতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ফোন এড়িয়ে গিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে ভারতীয় অর্থনীতিতে বড় ক্ষতির সম্ভাবনা কম। মার্কিন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে নয়াদিল্লির প্রবৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ৬.৫ শতাংশ থেকে ৫.৫ শতাংশে নেমে আসতে পারে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে উপেক্ষা করার সাহস দেখাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী।
তৃতীয়ত, ট্রাম্পের ফোন এড়িয়ে গিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজের গুরুত্ব বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন মোদী। জার্মান একটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কোনও পরিস্থিতিতেই আমেরিকার চাপে নয়াদিল্লি তার পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনবে না। এই অবস্থানের মাধ্যমে ভারতের প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে সেই বার্তা দিয়েছেন। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মার্কিন প্রভাব আগের তুলনায় কমে গেছে। তাই নয়াদিল্লি ট্রাম্পের হুমকিকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না।
চতুর্থত, গত ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লা থেকে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী মোদী ‘পণ্য ও পরিষেবা কর’ বা জিএসটিতে (গুড্স অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স) বড় পরিবর্তনের কথা ঘোষণা করেন। সূত্র অনুযায়ী, ভবিষ্যতে এই কর শুধুমাত্র দুটি ধাপে নেওয়া হবে, যথা পাঁচ এবং ১৮ শতাংশ। এ বছরের সেপ্টেম্বরের শুরুতে অনুষ্ঠিত জিএসটি কাউন্সিলের বৈঠকে এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, জিএসটিতে সেই পরিবর্তন এলে উৎসবের মরসুমে আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়তে পারে। তাই মোদী ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনে সময় নষ্ট না করে ঘরোয়া রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক সংস্কারে মনোনিবেশ করছেন। তাঁদের মতে, এতে ভবিষ্যতে তাঁর জনপ্রিয়তা আরও বাড়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়েছে।
বর্তমানে ভারতের রফতানি বাণিজ্যের এক পঞ্চমাংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল। এই পরিস্থিতিতে ট্রাম্প নয়াদিল্লির পণ্যে অন্যায্যভাবে ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দেওয়ায় এ দেশে তাঁর জনপ্রিয়তা দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, গত জুনে দেশের প্রতি দু’জনের মধ্যে এক জন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে সমর্থন করতেন। কিন্তু তা এখন প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে।
গত ৩১ জুলাই ট্রাম্প ভারতীয় অর্থনীতিকে ‘মৃত’ বলে সমালোচনা করেন। জার্মান সংবাদমাধ্যম ‘ফ্রাঙ্কফুর্টার’-এর মতে, এতে মোদী ভীষণ ক্ষুব্ধ হন এবং সেই সময় থেকেই তিনি বিকল্প বাজারের সন্ধান শুরু করেন। বর্তমানে নয়াদিল্লি সংঘাত পেছনে ফেলে চিনের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার চেষ্টা করছে। বেজিঙের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক তৈরির পরিকল্পনাও রয়েছে ভারতের ।
এ বছরের এপ্রিলে ট্রাম্প প্রশাসন পারস্পরিক শুল্কনীতি চালু করে। তখন ওয়াশিংটন ভারতীয় পণ্যে ২৬ শতাংশ কর আরোপ করে। এরপর শুল্ক এড়াতে দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এই আলোচনায় আমেরিকা ভারতের বাজার কৃষি এবং দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য বিক্রির জন্য খুলে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। তবে ভারতীয় কৃষক ও ডেয়ারি শিল্পের স্বার্থ বিবেচনা করে নয়াদিল্লি এই প্রস্তাবে সম্মতি দেয়নি।
ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে সংঘাতের কারণে ধৈর্য হারান ট্রাম্প। আলোচনার সময় তিনি বার বার অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের হুমকি দেন। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে নয়াদিল্লি রাশিয়া থেকে সস্তায় খনিজ তেল আমদানি করছে। জুলাই মাসে এসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট মোদীর উপর সেই আমদানি বন্ধের চাপ সৃষ্টি করেন।
ট্রাম্পের মতে, নয়াদিল্লি মস্কো থেকে খনিজ তেল আমদানি করায় ইউক্রেন যুদ্ধ থামছে না। ভারতের সঙ্গে এই ‘তরল সোনা’র বাণিজ্যের মাধ্যমেই ক্রেমলিন যুদ্ধ চালানোর প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করছে। তাই মোদী সরকার যদি এটি বন্ধ না করে, তবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার হুমকি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।
কিন্তু, সেই সময় নয়াদিল্লি কঠোর অবস্থান নেয়। জাতীয় স্বার্থে জ্বালানির প্রয়োজন মেটাতে রুশ খনিজ তেল ‘ক্রুড অয়েল ’-এর আমদানি বন্ধ করা হবে না, তা স্পষ্ট করে ওয়াশিংটনকে জানায় মোদী সরকার। ২১ অগস্ট মস্কো সফরে গিয়ে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেন, ‘‘আমরা রুশ তেলের শীর্ষ ক্রেতা নই। এই ক্ষেত্রে এক নম্বরে রয়েছে চিন।’’
এর পরেই আমেরিকা ও পশ্চিমি দুনিয়াকে আয়না দেখান ভারতের বিদেশমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘আমরা রাশিয়ার কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (লিকুইড ন্যাচরাল গ্যাস বা এলএনজি) কিনছি না। সম্ভবত সেটা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ২০২২ সালের পর মস্কোর সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক লেনদেন সর্বাধিক বাড়েনি। আমি মনে করি সেই তালিকায় দক্ষিণের কিছু দেশ রয়েছে।’’ তাঁর এই মন্তব্যের পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, এই দেশগুলির ক্ষেত্রে কেন ওয়াশিংটন এত কঠোর নয়?
ট্রাম্পের উপর মোদীর রাগের দ্বিতীয় কারণ হল তাঁর পাকিস্তান-প্রীতি। গত মে মাসে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সময় ভারত ইসলামাবাদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। চার দিন ধরে চলা এই লড়াইয়ের শেষে দু’পক্ষ সংঘর্ষবিরতিতে সম্মত হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট দাবি করেন, এ বিষয়ে তিনি মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেছিলেন। যদিও মোদী সংসদে বিবৃতি দিয়ে সেই দাবি খারিজ করেন।
ভারত-পাক সংঘাত মিটলে ইসলামাবাদের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির দু’বার যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করেন। ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁকে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করতে দেখা যায়। অগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্রে দাঁড়িয়ে মুনির ভারতকে পরমাণু হামলার হুমকি দেন। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট তখনও চুপ ছিলেন, যা নয়াদিল্লি তাঁর প্রচ্ছন্ন সমর্থন বলেই ধরে নেয়।
২৩ অগস্ট একটি অনুষ্ঠানে আমেরিকা ও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ‘প্রেমের সম্পর্ক’ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে জয়শঙ্কর তৎক্ষণাৎ ৯/১১ হামলার মূল চক্রী এবং কুখ্যাত জঙ্গি সংগঠন ‘আল-কায়দা’র প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন-লাদেনের প্রসঙ্গ টেনে আমেরিকাকে খোঁচা দেন। পাশাপাশি, তিনি ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদের ‘ইতিহাস বিস্মৃতি’র প্রবণতার কথাও উল্লেখ করেন।
আগামী ৩১ অগস্ট ‘সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা’ বা এসসিও-র (সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন) বৈঠকে যোগ দিতে চিনের তিয়ানজিনে যাবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানাতে পারেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এরপর সেপ্টেম্বরে ভারতে আসবেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের চীন -বিরোধী ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় নীতি বিশ বাঁও জলে যেতে পারে তা মনে করছেন অনেক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা ।