ক্ষমতায় এসে নানা সংস্কার করে ‘নতুন’ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন মহম্মদ ইউনুস। কিন্তু সেই পরিবর্তিত বাংলাদেশে এখন চরম অরাজকতা বিরাজ করছে। নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুরা। খুন, ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন বেড়ে গিয়েছে লাগামহীন হারে। মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাস মুছে ফেলার জন্য চলছে ‘ধ্বংসযজ্ঞ’। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে মুজিবের বাড়ি। মাথাচাড়া দিচ্ছে হিজবুত তাহরির মতো সন্ত্রাসী সংগঠন। এই পরিস্থিতে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি জানিয়েছেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব সেনাবাহিনী কাঁধে তুলে নেবে। তাহলে কি বাংলাদেশ আবার এক সেনা অভ্যুত্থান দেখবে?
গত বছরের জুলাই মাসে সরকারি চাকরিতে কোটা বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে পড়ুয়াদের একটি সংগঠন পথে নামে। জামাতের উসকানিতে তাদের সেই আন্দোলন হিংসাত্মক রূপ নেয়। গদি হারিয়ে শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করলে ক্ষমতায় আসে মহম্মদ ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকার। সেই সঙ্গে দাপাদাপি বাড়ে জামাতেরও। সরকারের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে এখন তাদের নেতারাই রয়েছে। দিকে দিকে বাড়বাড়ন্ত মৌলবাদীদের। দেশে যে হারে অপরাধের সংখ্যা বেড়েছে তাতে উদ্বিগ্ন সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান। গতকাল সোমবার বাংলাদেশের এক সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “যতদিন না বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত আমিই সেনাপ্রধান দায়িত্ব পালন করব। আগামী দিনে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব সেনা নেবে।”
দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ইতিমধ্যেই ইউনুস সরকারের বিরুদ্ধে পথে নেমেছে ছাত্র-জনতা। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি জানানো হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে সেনাপ্রধান আরও বলেন, “আমরা প্রাথমিকভাবে ভেবেছিলাম এই সব কাজ তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে এবং আমরা ব্যারাকে ফিরে যাব। কিন্তু এখন দেখছি আমাদেরই কাজ করতে হবে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি। কিন্তু এখন আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে এবং সম্পূর্ণ নিষ্ঠা ও শৃঙ্খলার সঙ্গে আমাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হবে।” বিশ্লেষকদের মতে, সেনাপ্রধানের এহেন মন্তব্যে ইউনুসের চিন্তা বাড়বে। আগামী দিনে ফের আরেক সেনা অভ্যুত্থান হতে পারে বাংলাদেশে।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই বাংলাদেশকে বেশ কয়েকবার সামরিক অভ্যুত্থানের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এই তালিকার শুরুতেই রয়েছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনা। তৎকালীন মেজর শরিফুল হক (ডালিম) বীর উত্তম, মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান এবং মেজর রশিদের নেতৃত্বে বাংলাদেশেবারের মতো সেনা অভ্যুত্থ ঘটে। এই অভ্যুত্থানের ফলেই বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের হত্যা সংঘটিত হয়। নিহত হন তাঁর অন্যান্য সদস্যরাও। কেবল দুই মেয়ে শেখ হাস ও শেখ রেহানা সেই সময় জার্মানিতে অবস্থান করার কারণে প্রাণে বেঁচে যান। সেবারের অভ্যুত্থানে কয়েকজন মন্ত্রী ও আওয়ামি লিগের নেতাও নিহত হন।
সেই অভ্যুত্থানের আড়াই মাস পর, ৩ নভেম্বর সেনাবাহিনীর গঠিত সরকারও আরেকটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ভেঙে যায়। এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব জেনারেল খালেদ মোশারফ বীর উত্তম। সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দি করা হয়। কিন্তু এটি চার দিনের বেশি স্থায়ী হয়নি। ৭ নভেম্বর ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা জিয়াউর রহমানকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে মুক্ত করে। খালেদ মোশারফ নিহত হন।
জিয়াউর রহমান ২১টি অভ্যুত্থানের মুখোমুখি হয়েছিলেন। কিন্তু পাঁচ বছরের শাসনকালে সেগুলো সামাল দিতে পারলেও ২২ নম্বর অভ্যুত্থানে মারা যান তিনি। ১৯৮১ সালের ৩০ মে তাঁর মৃত্যুর পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন আব্দুস সাত্তার। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ আব্দুস সাত্তারের সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সেই সময় সেনাপ্রধানের দায়িত্বে থাকা প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। ১৯৯১ তাঁর পতনের পর বাংলাদেশে ফের নির্বাচন ব্যবস্থা ফিরে আসে। এরপর বেশ কয়েকটি সেনা অভ্যুত্থানে রক্ত ঝরেছে বাংলাদেশে।