বাংলাদেশে ৪১ জনের প্রাণহানি ঘটেছে, কিন্তু হিংসা এখনও থামেনি। গত দুই সপ্তাহ ধরে কোটা বিরোধী বিক্ষোভ চলছে, যা সম্প্রতি হিংসাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। ক্ষমতাসীন দল এবং তার সহযোগী দলগুলি ঢাকা সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় আন্দোলনকারী ছাত্রদের উপর হামলা চালিয়েছে, যার ফলে একাধিক মৃত্যু এবং চার শতাধিক আহতের ঘটনা ঘটেছে। ছাত্ররা সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সংশোধনের দাবি নিয়ে আন্দোলন করছেন। কোটা ব্যবস্থা হলো সরকারি চাকরিতে নিয়োগের জন্য নির্দিষ্ট শতাংশ আসন সংরক্ষণের একটি পদ্ধতি।
বাংলাদেশে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যেই ছাত্রছাত্রীরা সরকারি চাকরির কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে পথে নেমেছেন। ঘটনার শুরু ১ জুলাই এই বছর। হাইকোর্ট জানিয়েছে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নেওয়া যোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য সিভিল সার্ভিসের এক-তৃতীয়াংশ পদ সংরক্ষিত রাখা হবে। এই কোটা আগে থেকেই ছিল, হাইকোর্ট তা পুনরায় বহাল করেছে। তাহলে নতুন করে বিক্ষোভের কারণ কী? কেন কোটা ব্যবস্থার বিরোধিতা করা হচ্ছে?
সারা বাংলাদেশে মূলত সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চাকরির কোটা পদ্ধতির সংস্কার চাইছে। বর্তমান কোটা ব্যবস্থায় অর্ধেকেরও বেশি সরকারি চাকরি সংরক্ষিত। বিক্ষোভকারীরা জানিয়েছেন, তাদের কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্ক নেই। তারা নিজেদের অধিকারের দাবিতে পথে নেমেছেন। তারা সংরক্ষণ নয়, চাকরিতে যোগ্যতা-ভিত্তিক ব্যবস্থা চান, যা সবার জন্য প্রযোজ্য হবে। বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা একটি ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে প্রথম বিক্ষোভের আয়োজন করেছিল, যেখানে কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সমর্থন ছিল না।
এই বিক্ষোভের শুরুটা কোথায়?
২০১৮ সালে বাংলাদেশে কোটাব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছিল, যা হাইকোর্ট অবৈধ বলে ঘোষণা করে। গত ৫ জুন, হাইকোর্ট মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা পুনর্বহালের নির্দেশ দিয়েছে। এই সিদ্ধান্তের আগে, ব্যাপক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা পদ্ধতি বাতিল করেন।
বাংলাদেশের এই কোটা পদ্ধতি ঠিক কী?
১৯৭২ সালে, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান একটি কোটা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। এই ব্যবস্থা অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধে যে মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই করেছিলেন, তাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য সরকারি চাকরিতে একটি নির্দিষ্ট শতাংশ সংরক্ষিত করা হয়।
এই সংরক্ষণ পদ্ধতিতে, প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৪৪% আসন মেধা ভিত্তিক নির্ধারিত। বাকি ৫৬% আসন নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে:
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য ৩০%
মহিলাদের জন্য ১০%
অনগ্রসর জেলার জন্য ১০% ‘জেলা কোটা’
জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য ৫%
শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য ১%
কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের দাবি কী?
ছাত্রছাত্রীরা পথে নেমেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য নির্ধারিত ৩০ শতাংশ কোটা বাতিলের দাবিতে। তবে এই পড়ুয়ারা সব ধরনের কোটা উঠিয়ে দেওয়ার পক্ষে নন; তারা জাতিগত সংখ্যালঘু এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য চাকরি সংরক্ষণের সমর্থন করেন। তারা কোটা বাতিলের পক্ষে নয়, বরং সংরক্ষণ পদ্ধতির সংস্কারের পক্ষে এবং সংরক্ষিত চাকরির শতাংশ কমানোর পক্ষে।
১৯৭৬ সালে, কোটা ব্যবস্থায় প্রথম পরিবর্তন আনা হয়, যখন মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ বাড়ানো হয় এবং মহিলাদের জন্য পৃথক কোটা চালু করা হয়। মোট কোটার ৪০ শতাংশ মেধা, ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারী এবং বাকি ১০ শতাংশ জেলার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়।
১৯৮৫ সালে, সংস্থাপন মন্ত্রক কোটা পদ্ধতি সংশোধন করে, সংখ্যালঘুদের কোটায় অন্তর্ভুক্ত করে এবং মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ বাড়িয়ে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরির পদের জন্য মেধাভিত্তিক কোটা হয় ৪৫ শতাংশ এবং জেলাভিত্তিক কোটা হয় ৫৫ শতাংশ, যার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০ শতাংশ, মহিলাদের ১০ শতাংশ এবং উপ-জাতীয়দের জন্য ৫ শতাংশ পদ সংরক্ষিত থাকে।
যদিও ১৯৯০ সালে নন-গেজেটেড পদের নিয়োগে কোটা পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন আনা হয়, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে এটি অপরিবর্তিত থাকে। ১৯৯৭ সালে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের অন্তর্ভুক্তি ঘটে। ১৯৮৫ সালের কোটা ব্যবস্থা বজায় রেখে, মুক্তিযোদ্ধা কোটার ৩০ শতাংশের জন্য যদি উপযুক্ত মুক্তিযোদ্ধা প্রার্থী না পাওয়া যায়, তবে মুক্তিযোদ্ধা বা শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের পুত্র-কন্যাদের জন্য সেই কোটা বরাদ্দ করার নির্দেশ জারি করা হয়।
২০০২ সালে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিষয়ে পূর্বের নিয়ম বাতিল করে এবং নির্দেশ দেয় যে, ২১তম বিসিএস পরীক্ষা থেকে যদি মুক্তিযোদ্ধা কোটার ৩০% পূরণ করা না যায়, তবে শূন্যপদগুলো মেধাভিত্তিক তালিকায় শীর্ষে থাকা প্রার্থীদের দিয়ে পূরণ করা যাবে।
২০০৮ সালে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠনের পর এই নির্দেশ বাতিল করা হয় এবং যদি মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য নির্ধারিত কোটা পূরণ করা না যায়, তবে পদ খালি রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। ২০১১ সালে কোটা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হয়, যেখানে মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিদেরও ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সর্বশেষ, ২০১২ সালে সরকার এক শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা যুক্ত করে।
কোটা আন্দোলন প্রথম বড় আকার নেয় ২০১৮ সালে। ওই বছরের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল এবং এর পুর্নমূল্যায়ন চেয়ে হাইকোর্টে পিটিশন দায়ের করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র ও দুই সাংবাদিক কিন্তু মার্চ মাসে এসে ওই লিখিত আবেদন খারিজ করে দেয় সর্বোচ্চ আদালত। ফেব্রুয়ারি মাসে ফেসবুকে ‘কোটা সংস্কার চাই’ নামে একটি পেজ খোলা হয় এবং শাহবাগকে কেন্দ্র করে পেজটি থেকে মানবন্ধনসহ নানা কর্মসূচির ঘোষণা শুরু হয়। এর মাধ্যমেই মূলত কোটা সংস্কার আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। এই সময় কোটা সংস্কারের উদ্দেশ্যে ‘বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ নামে একটি প্ল্যাটফর্মও গঠন করা হয়।
ওই পিটিশন খারিজ হওয়ার পর কোটা পদ্ধতিতে কোনও পরিবর্তন করা হবে না, এই মর্মে আদেশ জারি করা হয়। তবে কোটা কার্যকর করার ক্ষেত্রে কিছুটা শৈথিল্য আনে সরকার। আদেশে জারি করে বলা হয়, সব ধরনের সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধা তালিকার শীর্ষে অবস্থানকারী প্রার্থীদের দিয়ে সেসব পদ পূরণ করা হবে। অর্থাৎ আগে যেখানে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পূরণ না হলে কোটা খালি রাখার কথা বলা হয়েছিল, সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার এবং মেধা তালিকা থেকে নিয়োগের কথা জানায়। তবে দাবি আদায়ে অনড় থাকে পড়ুয়ারা। সকলের জন্য ন্যায্য চাকরির সুযোগ চেয়ে রাস্তায় নামেন তারা।
টানা আন্দোলনের জেরে সেই বছরের ১১ এপ্রিল সংসদে দাঁড়িয়ে সব ধরনের কোটা বাতিলের ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখা হাসিনা। এসময় নবম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত অর্থাৎ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা বাতিল করে বিজ্ঞাপন জারি করে সরকার। ১৪ তম থেকে ২০তম অর্থাৎ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদগুলোতে কোটায় প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধা থেকেই নিয়োগের কথাও জানানো হয়।
২০২১ সালে, কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাইকোর্টে কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পিটিশন দায়ের করেন। এ বছরের ৫ জুন, আদালত তাদের পক্ষে রায় দেয়, যার অর্থ আগের মতো কোটা বহাল থাকবে। এর প্রতিবাদে, ১ জুলাই থেকে শিক্ষার্থীরা কোটা বাতিলের আন্দোলনে আবার নেমেছে।