সত্যিই কি ডিজিটাল মুদ্রার দুনিয়ায় পা রাখতে চলেছেন ভারতের ধনীতম শিল্পপতি তথা রিলায়্যান্স ইন্ডাস্ট্রিজের কর্ণধার মুকেশ অম্বানী? তাঁর ‘জিয়োকয়েন (Jio coin)’কে কেন্দ্র করে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
যদিও রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে জিও কয়েনের (Jio coin) উদ্বোধন সম্পর্কে কোনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়নি, গুজব রয়েছে যে এটি ভারতে ডিজিটাল মুদ্রা এবং ব্লকচেইন-ভিত্তিক পরিষেবার ক্রমবর্ধমান বাজারে প্রবেশের লক্ষ্যে কাজ করতে পারে।
রিলায়েন্স যে ক্রিপ্টোকারেন্সির দুনিয়ায় প্রবেশ করতে চলেছে, সেই খবর প্রথম প্রকাশ্যে আনে পলিগন ল্যাবস নামের একটি ভারতীয় ব্লকচেন সংস্থা। চলতি বছরের (২০২৫) ১৫ জানুয়ারি তাদের সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি করে মুকেশের সংস্থা জিও। এর পর অম্বানিরা নতুন ডিজিটাল মুদ্রা বাজারে আনছেন বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে।

প্রসঙ্গত, বিটকয়েনের মতোই ইথেরিয়াম নামের একটি ক্রিপ্টো মুদ্রা রয়েছে। এই ডিজিটাল মুদ্রার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে পলিগন। ভার্চুয়াল মুদ্রাটির গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিচ্ছে ভারতীয় ব্লকচেন সংস্থা। তাদের সঙ্গে রিলায়েন্স জিওর সমঝোতায় ভারতীয় বাজারে অম্বানিদের নতুন ডিজিটাল মুদ্রা আসার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
পলিগনের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি বিষয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছিল রিলায়্যান্স জিয়ো। সেখানে বলা হয়, গ্রাহকদের কাছে ‘ওয়েব ৩’ পরিষেবা পৌঁছে দিতে কাজ করবে এই ভারতীয় ব্লকচেন সংস্থাটি। বিষয়টি নিয়ে সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারীদের একাংশ এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) পোস্ট করতে শুরু করেন। সেখানেই তাঁদের প্রশ্নের উত্তর দেন পলিগনের প্রতিষ্ঠাতা সন্দীপ নেলওয়াল।
নিজের লেখায় ‘জিয়োকয়েন’(Jio coin) শব্দটি ব্যবহার করেন সন্দীপ। অচিরেই তা ভাইরাল হয়ে যায়। রিলায়্যান্স জিয়োর তরফে এ ব্যাপারে সরকারি ভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়নি। কয়েক বছর আগে মুকেশ অম্বানীর সংস্থা অবশ্য জানিয়েছিল, এ দেশের বাজারে কোনও ক্রিপ্টো মুদ্রা আনার পরিকল্পনা করছেন না তাঁরা।
ক্রিপ্টো মুদ্রা হিসেবে ‘জিয়োকয়েন’ (Jio coin) বাজারে না এলেও এর অস্তিত্ব নেই, তা ভাবা ভুল হবে। এটি মূলত একটি ব্লকচেনভিত্তিক পুরস্কার টোকেন। জিয়োর ইন্টারনেট, অ্যাপ এবং পরিষেবা ব্যবহারকারী গ্রাহকেরা মুকেশের সংস্থার থেকে এটি উপার্জন করেন। শুধু তা-ই নয়, নিখরচায় এই ডিজিটাল মুদ্রায় পকেট ভরানোর সুযোগও রয়েছে তাঁদের।
অম্বানীরা কীভাবে গ্রাহকদের মধ্যে ‘জিয়োকয়েন’ বিতরণ করছেন, তা বুঝতে হলে এই সংস্থার ব্যবসায়িক মডেলটি জানতে হবে। ২০১৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর জিয়ো ইন্টারনেট পরিষেবা বাজারে নিয়ে আসেন রিলায়্যান্স কর্ণধার। সেই সময়ে গ্রাহকদের বিনামূল্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছিলেন তিনি।
পরবর্তীকালে একাধিক নতুন পরিষেবা চালু করে জিয়ো। এর মধ্যে রয়েছে বিনোদন ও খেলার চ্যানেল বা আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত অ্যাপ। ধীরে ধীরে জিয়ো ইন্টারনেট পরিষেবাও আর বিনামূল্যের থাকে না। বর্তমানে ‘জিয়োস্পিয়ার’ নামের অ্যাপভিত্তিক একটি ওয়েব ব্রাউজার রয়েছে মুকেশের সংস্থার। এটি বহুজাতিক টেক জায়ান্ট গুগলের সার্চ ইঞ্জিনের মতো কাজ করে।

‘জিওস্পিয়ার’-এর গ্রাহকদের পুরস্কার হিসেবে ‘জিওকয়েন’ দিচ্ছে অম্বানিদের সংস্থা। অর্থাৎ জিওর ইন্টারনেট এবং অন্যান্য পরিষেবা গ্রহণকারীরা এই ডিজিটাল মুদ্রা উপার্জন করতে পারবেন। জিওকয়েনের মাধ্যমে বিভিন্ন বিল পরিশোধ করা যাবে। যদিও এর মূল্য এখনও নির্ধারণ করেননি ভারতের ধনীতম শিল্পপতি।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, এক একটি ‘জিওকয়েন’-এর মূল্য ৪৩ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। বর্তমানে জিওর গ্রাহকসংখ্যা প্রায় ৪৫ কোটি। তাঁদের প্রত্যেকের কাছে ওই ডিজিটাল মুদ্রা পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে মুকেশের টেলিকম সংস্থার।
‘জিওকয়েন’(Jio coin) উপার্জন করতে হলে ব্যবহারকারীকে অবশ্যই ‘জিওস্পিয়ার’ অ্যাপের মাধ্যমে এর প্রোগ্রামে নাম নথিভুক্ত করতে হবে। অ্যান্ড্রয়েড, আইওএস, উইন্ডোজ এবং ম্যাক— সব ধরনের প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মেই এর যোগ রয়েছে। একাধিক আঞ্চলিক ভাষার সুবিধাও এতে দিয়েছে রিলায়েন্স।
সূত্রের খবর, এই ‘জিওস্পিয়ার’ আরও উন্নত করতে ব্লকচেন সংস্থা পলিগন কাজ করবে। গ্রাহকেরা এতে নিজেদের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষিত রাখতে পারবেন। ওয়েব ব্রাউজারটিকে বিজ্ঞাপনের জন্য আরও ভালোভাবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা রয়েছে রিলায়েন্স জিওর। মাইজিও, জিওসিনেমা, জিওমার্টের পাশাপাশি এতে আরও অনেক কিছু বিকশিত করার পরিকল্পনা রয়েছে মুকেশের সংস্থার।
‘জিয়োকয়েন’ উপার্জনের জন্য গ্রাহকদের বিভিন্ন পদ্ধতি গ্রহণ করতে বলেছে রিলায়্যান্সের টেলিকম সংস্থা। এর মধ্যে রয়েছে, ওয়েব ব্রাউজিং, ভিডিও দেখা, বিভিন্ন প্রবন্ধ পড়া বা তথ্য সংগ্রহ, গেমিং, ভিপিএন পরিষেবার ব্যবহার, সেটিংস কাস্টমাইজ করা। তবে অবশ্যই এই সমস্ত কাজ ‘জিয়োকয়েন’ প্রোগ্রামে সাইন আপের পর করতে হবে।
একবার খরচ করার পর ফের ‘জিয়োকয়েন’ পুনরুদ্ধার করা যাবে। যদিও এর রূপরেখা প্রকাশ করা হয়নি। এই ডিজিটাল মুদ্রা কোথায় ব্যবহার করা যাবে তাও স্পষ্ট নয়। বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, মোবাইল এবং ব্রডব্যান্ড রিচার্জ, জিয়োমার্টে কেনাকাটা এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলিতে বিল পরিশোধে এটি ব্যবহার করা যাবে।
রিলায়্যান্স জিয়োর সঙ্গে অংশীদারিত্বের বিষয়ে ইতিমধ্যেই মুখ খুলেছেন পলিগনের প্রতিষ্ঠাতা সন্দীপ নেলওয়াল। কথায়, “ভারতে ওয়েব৩ প্রযুক্তি আনার এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। মুকেশ অম্বানীর সংস্থার সঙ্গে কাজ করার জন্য মুখিয়ে রয়েছি। জিয়োর গ্রাহক উন্নত ওয়েব প্রযুক্তির স্বাদ পেতে চলেছেন।”

বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, ওয়েব৩ প্রযুক্তি পুরোপুরি চালু হলে ‘জিয়োকয়েন’কে ক্রিপ্টো মুদ্রা হিসাবে বাজারে আনতে পারেন মুকেশ অম্বানী। সে ক্ষেত্রে জিয়োর গ্রাহক ছাড়াও জনগণ এতে লগ্নি করতে পারবেন। তবে ভার্চুয়াল মুদ্রাটিকে আয়কর সংক্রান্ত সরকারি কঠোর নিয়মের মধ্যে পড়তে হবে।
আয়কর আইন অনুযায়ী, ক্রিপ্টো মুদ্রা থেকে মুনাফার উপর গ্রাহককে ৩০ শতাংশ কর দিতে হয়। এ ছাড়া টিডিএস বাবদ কেটে নেওয়া হয় আরও এক শতাংশ টাকা। ‘জিয়োকয়েন’ ভার্চুয়াল মুদ্রা হিসাবে বাজারে এলে তার উপর কড়া নজর রাখবে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (আরবিআই) এবং সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ বোর্ড অফন্ডিয়া (সেবি)।
২০১৮ সালে একবার মুকেশ অম্বানী ক্রিপ্টো মুদ্রা হিসাবে ‘জিয়োকয়েন’কে বাজারে আনছেন বলে খবর ছড়িয়েছিল। কিন্তু তা অস্বীকার করে রিলায়্যান্স গোষ্ঠী। বর্তমানে মুকেশ-পুত্র আকাশ অম্বানীর নেতৃত্বে ৫০ জনের একটি দল এই ডিজিটাল মুদ্রাটিকে নিয়ে কাজ করছেন বলে খবর পাওয়া গিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের অনুমান, চলতি বছরেই (পুন ২০২৫) ‘জিয়োকয়েন’-এর বাজারমূল্য ঘোষণা করবেন মুকেশ। পাশাপাশি, একে পুরোপুরি ক্রিপ্টো মুদ্রা হিসাবে লঞ্চ করতে পারেন তিনি। কেউ কেউ আবার বলছেন, ‘জিয়োকয়েন’কে শুধু মাত্র জিয়োর গ্রাহকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবে রিলায়্যান্স।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হতেই ক্রিপ্টো মুদ্রার দুনিয়ায় এসেছে সুনামি। তিনি বলেন, আমেরিকায় বড় আকারের ভার্চুয়াল মুদ্রার ব্যাঙ্ক গড়ে তুলবেন তিনি। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বিটকয়েনসহ সমস্ত ভার্চুয়াল মুদ্রার দাম। বর্তমানে একটি বিটকয়েনের মূল্য ভারতীয় টাকায় প্রায় ৯১ হাজারে পৌঁছে গিয়েছে।
প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেওয়ার আগে নিজের নামে একটি ক্রিপ্টো মুদ্রা বাজারে এনেছেন ট্রাম্প। এর মালিকানার একাংশ আমিকার ফার্স্ট লেডি তথা ডোনাল্ড-পত্নী মেলানিয়ার হাতে রয়েছে। বাহুল্য, ট্রাম্প কুর্সিতে বসার পর থেকে এর দাম আকাশ ছুঁয়েছে।
ভারতের নিজস্ব কোনও ক্রিপ্টো মুদ্রা নেই। এই ভার্চুয়াল মুদ্রাকে নিয়ন্ত্রণ করা যথেষ্ট কঠিন। তবে নয়াদিল্লির নিজস্ব ডিজিটাল মুদ্রা চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে।এর জন্য নতুন আইনও পাশ করাতে পারে কেন্দ্র। এই ইস্যুতে রিজ়ার্ভ ব্যের শীর্ষকর্তারা কাজ করছেন বলে জানা গিয়েছে।